৭ নভেম্বর ২০১৭ মঙ্গলবার ৪:৪০:৩১ পূর্বাহ্ন Print this E-mail this

শ্র দ্ধা ঞ্জ লী

বরিশালের মুকুটহীন সম্রাট মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত
নিউজ ডেস্ক

আজ ৭ নভেম্বর মঙ্গলবার। ১৯২৩ সালের এই দিনে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন বরিশালের মুকুটহীন সম্রাট আধুনিক বরিশালের রূপকার, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ও শিক্ষানুরাগী মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত।

১৮৫৬ সালের ২৫ জানুয়ারী তৎকালীন বরিশাল জেলার পটুয়াখালী মহকুমা শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তিনি আমৃত্যু রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকে বরিশালবাসীর জন্য নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করেছেন।

আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটি ১৮৮৪-১৯২৩ সাল পর্যন্ত শুধু বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদেরই মানুষ করেননি বরং সমাজের অনেক অশিক্ষিত, অবহেলিত ও বঞ্চিত মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বাউণ্ডুলে স্বভাবের বখাটে মুকুন্দদাসকে তিনিই দিনের পর দিন বাড়িতে ডেকে এনে আদর, স্নেহ ও ভালবাসা দিয়ে এক নতুন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। যে কারণে মুকুন্দদাস একসময় চারণ সম্রাট মুকুন্দদাস হতে পেরেছিলেন।

অশ্বিনী কুমার দত্তের পৈতৃক বাড়ি বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলাধীন বাটাজোর গ্রামে। তাঁর পিতা ব্রজমোহন দত্ত একজন সাব-জজ ছিলেন। আর মা প্রসন্নময়ী ছিলেন বানরীপাড়ার রাধাকিশোর গুহের মেয়ে। বাবার মতো মাও ছিলেন মানবতাবাদী ও দেশপ্রেমিক। ব্রজমোহন দত্ত ও প্রসন্নময়ীর পরিবারে ৪টি ছেলে ও ২ টি মেয়ের জন্ম হয়। অশ্বিনীকুমার দত্ত ছিলেন ওই পরিবারের বড় ছেলে।

mohatta-ashwini-kumar-dutta মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তপিতার সরকারি চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশুনা তাঁকে পূর্ববাংলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজে সম্পন্ন করতে হয়। পিতার কর্মস্থল ঢাকা, ঢাকা থেকে দৌলত খা, রংপুর প্রভৃতি স্থানে পড়াশুনা করে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেয়ার যোগ্য হয়ে উঠেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ১৪ বছর। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুসারে ১৭ বছরের নিচে কেউ পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার পেত না।

তাই অশ্বিনীকুমার দত্তের বয়স বাড়িয়ে দিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়ে ওই কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে এফ এ ক্লাসে ভর্তি হন। এরপর তিনি এলাহাবাদ হাইকোর্ট থেকে আইন পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। ২৩ বছর বয়সে বি এ (১৮৭৮) এবং এক বছর বাদে এম এ পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। তারপর তিনি ১৮৭৯ সালে বি এল পরীক্ষা দেন এবং এ পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। ওই বছর তিনি শ্রীরামপুরের নিকটে চাতরা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন।

১৮৭৯ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ এবং একই বছর বি.এল পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হন। ওই বছর তিনি শ্রীরামপুরের নিকট চাতরা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি এই স্কুলের সার্বিক উন্নয়ন করতে সক্ষম হন। ১৮৮০ সালে বরিশালে এসে তিনি ওকালতি পেশা শুরু করেন।

অশ্বিনীকুমার যখন বি.এল পাস করে আইন ব্যাবসা শুরু করেন বরিশালে তখন সেইখানে এক অরাজক অবস্থা বিরাজ করছিল। বার লাইব্রেরীতে উকিলরা অত্যন্ত কদর্য আর অশ্লীল ভাষায় কথা না বলে আনন্দ পেতেন না। অতিরিক্ত মদ্য পান এবং গনিকালয় এ যাওয়া অনেক কৃতিত্বর মনে করা হতো। সে সময় সার্থক উকিলেরা তাদের প্রিয় গনিকার বাড়িতে বসেই মক্কেলদের সাথে কথাবার্তা বলতেন।

মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত্ব - ফাইল ফটোআদর্শবান এবং চরিত্রবান উকিল অশ্বিনীকুমার এই পরিস্থিতি সহ্য করতে পারলেন না। উকিলদের এইসব জঘন্য কার্যকলাপ এর জন্য তিনি নিজে উকিল হয়েও ওইসব উকিলদের বিরুদ্ধে বার লাইব্রেরী, কোর্ট চত্তর ও পথে ঘাটে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন। তাঁর আবেদনময় এবং যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা শুনে বরিশাল শহরের মানুষ শুধু অনুপ্রানিত ও মুগ্ধ হতো না, তারা প্রকাশ্যেই ওই উকিল আর ধনীদের অশ্লীলতা আর কদর্যতার বিপক্ষে মুখর হয়ে উঠলো। তাঁর এই উদ্যোগ এর কারনেই বন্ধ হল উকিলদের এই কদর্যতা।

অশ্বিনীকুমার শুধুমাত্র উকিলদের সংযত করেই খুশি হলেন না বরং তিনি পথে-ঘাটে, হাতে-বাজারে, ষ্টীমার ঘাটে ও মাঝি-গোয়ালা থেকে শুরু করে চাত্র-শিক্ষক-অধ্যাপকদের সামনেও জীবনে সত্য-প্রেম-পবিত্রতা সম্পর্কে অত্যন্ত আবেগময় কিন্তু যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন এবং আপামর সাধারণ মানুষও প্রভাবিত হতে আরম্ভ করলো।

সেসময় বরিশালের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা নানাদিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল। রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে কলকাতাকে কেন্দ্র করে যে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ শুরু হয় তা থেকে বরিশাল ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। গুটিকয়েক জমিদার ও সরকারি কর্মচারীর পরিবার ছাড়া বরিশালের প্রায় গোটা সমাজ পাশ্চাত্য শিক্ষা থেকে ছিল সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে।
১৮৮২ সালে অশ্বিনীকুমার ব্রাহ্মসমাজের সভ্য হন।

এ সময় তিনি বরিশালের ছাত্রসমাজের উন্নতির জন্য নিরলসভাবে নানাবিদ কাজ করতে শুরু করেন। বরিশালের যুবসমাজ অশ্বিনী কুমারের জীবনাদর্শ “সত্য প্রেম পবিত্রতা”র মন্ত্র গ্রহণ করে। ব্রাহ্মসমাজ ও অশ্বিনী কুমারের উদ্যোগে সেবক দল গঠন করা হয়। এই সেবক দল ছাত্রসমাজের শিক্ষাবিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এতে করে বরিশালের গণমানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমের এক নবজাগরণ ঘটে। ফলে ধীরে ধীরে মানুষের চেতনা থেকে মধ্যযুগীয় চিন্তা ও বিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটে।

১৮৮৪ সালে বরিশালে হাজারে মাত্র ৭ জন শিক্ষিত ছিল। তখন সমগ্র জেলায় ১৫ জনের মতো গ্রাজুয়েট ছিল। সমাজ জীবনে বিশেষত: অভিজাত সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার মধ্যে দুর্নীতি, ব্যাভিচার, অজ্ঞানতা, কুসংস্কার ও অনৈতিকতা জেঁকে বসেছিল। অশ্বিনীকুমার দত্ত বরিশালের এই দুর্দশা দেখে মর্মাহত হন এবং এসব প্রতিরোধে সর্বাত্মক চেষ্টা করেন।

অশ্বিনীকুমার সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন যে সৎ শিক্ষার প্রসার অত্যন্ত জরুরী এবং সেই উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ১৮৮৪ সালে পিতার নামে ব্রজমোহন বিদ্যালয় এবং তার পাঁচ বছর পরে ১৮৮৯ সালে ব্রজমোহন কলেজ স্থাপন করলেন। এই কলেজও সারা বাংলায় খ্যাতি অর্জন করেছিল। এই সময়েই তিনি উপলব্ধি করলেন মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ওকালতি করা যায় না এবং ওকালতি ছেড়ে তিনি শিক্ষা প্রসারে আত্মনিয়োগ করলেন। তিনি নিজের গ্রাম বাটাজোড় এও একটি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করলেন।

গণসচেতনতা সৃষ্টির তাগিদে এ সময় অশ্বিনীকুমার দত্ত সংবাদপত্রের অভাব বিশেষভাবে অনুভব করেন। তাঁর চেষ্টার কারণে বিকাশ, স্বদেশী, বরিশাল, বরিশাল হিতৈষী প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বরিশাল হিতৈষী ও স্বদেশী পত্রিকা অসহযোগ আন্দোলনে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে। এই পত্রিকাগুলো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও শিক্ষাবিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।

অশ্বিনীকুমারের আন্তরিকতাপূর্ণ কথাবার্তা, উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতা ও সমাজ-সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে অল্পদিনের মধ্যে তিনি সবার প্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন । ক্রমে ক্রমে তাঁর প্রচেষ্টা সফল হতে থাকে। তিনি নানাবিধ দুর্নীতি, অসামাজিক কার্যকলাপ, গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা ও সংগীতের পাশাপাশি জনসাধারণের প্রতিনিধি সভা সংগঠিত করেন।

অশ্বিনীকুমারের একান্ত চেষ্টায় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপিত হয়। জনপ্রিয়তার কারণে তিনি বরিশাল পৌরসভা ও লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এসময় তিনি এ কে ফজলুল হককে পৌরসভা ও জেলা বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত করেন। মূলত অশ্বিনীকুমারের হাতেই শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি হয়।

বরিশালের সমাজজীবনে তিনি প্রথম রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি করেন। গঠন করেন বরিশাল জনসাধারণ সভা। এই রাজনৈতিক সংগঠনটিকে তিনিই ধীরে ধীরে শক্তিশালী রূপে গড়ে তোলেন। জাতীয় কংগ্রেসের আগে এই রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম হয়। ১৮৮৬ সাল থেকে বরিশাল জনসাধারণ সভা কংগ্রেসের সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করে।

১৯০৫ সালে বঙ্গ বিভাগের কারণে স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন গড়ে ওঠে। বয়কট আন্দোলন এক সময় স্বরাজলাভের আন্দোলনে রূপ নেয়। এসময় বাংলা বিভক্তির প্রতিবাদে অশ্বিনী কুমারের নেতৃত্বে বরিশালে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। বরিশালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন যতটা তীব্র আকার ধারণ করেছিল বাংলার আর কোথাও তার নজির নেই। তিনি ছিলেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অগ্রনায়ক।

এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটান। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় অশ্বিনীকুমার যখন বরিশাল বা অন্যত্র বক্তৃতা দিতেন, তখন সেই বক্তৃতার আগে জাতীয় সংগীত গাওয়া হত। জাতীয় সংগীতের পরে দেশাত্মবোধক গান গাওয়া হত। কিন্তু সেসময় তেমন দেশাত্মবোধক গান ছিল না। তাই এসময় তিনি বেশকিছু দেশাত্ববোধক গান রচনা করেন।

১৯০৫-০৮ সাল পর্যন্ত বরিশালে অশ্বিনীকুমারের নেতৃত্বে যে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন গড়ে উঠে তা বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এমন কি বাংলার বাইরেও অনেক প্রদেশে এই আন্দোলনের প্রভাব পড়ে। অন্যান্য প্রদেশের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন জনসভায় অশ্বিনীকুমার ও বরিশালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উদাহরণ দিতেন।

অশ্বিনীকুমারের নেতৃত্বে স্বদেশবান্ধব সমিতি শহরে ও গ্রামে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করত। এই সমিতির কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য সরকার অশ্বিনীকুমারসহ ৯ জন নেতাকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন আইনে গ্রেফতার করে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। এ সময় অশ্বিনীকুমারকে রাখা হয় লক্ষ্ণৌ জেলে।

১৯১০ সালে তিনি মুক্তিলাভ করেন। মুক্তির পর তিনি জেলা স্বদেশবান্ধব সমিতির সভাপতির পদ গ্রহণ করেন। সমিতির পক্ষ থেকে প্রচারক পাঠিয়ে তিনি গ্রামে গ্রামে নিম্ন বিদ্যালয় স্থাপন, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত গ্রামে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পথ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। ১৯২১ সালে বরিশালে স্টিমার ধর্মঘটের সময় তিনি অসুস্থ ছিলেন এবং এ অবস্থায় তিনি স্বেচ্ছাসেবকদের যাবতীয় কাজ দেখভাল করেন। ১৯২২ সালে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯২৩ সালের ৭ নভেম্বর তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। পুন:প্রকাশিত

সম্পাদনা: বরি/প্রেস/মপ

শেয়ার করতে ক্লিক করুন:



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews