বাঙালি জাতির এক মহীয়সী নারীর নাম বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর শক্তি ও অনুপ্রেরণার নাম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বাংলার মানুষের কাছে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার নাম বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব।

বেগম মুজিব সম্পর্কে একটি সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, আমার জীবনে দুটি বৃহৎ অবলম্বন। প্রথমটি হলো আত্মবিশ্বাস, দ্বিতীয়টি হলো আমার স্ত্রী আকৈশোর গৃহিণী।

ছোটবেলা থেকে বঙ্গবন্ধু যে পরিবেশ ও পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন, শেখ ফজিলাতুন নেছাও একই পরিবেশে বড় হয়েছেন; এমনকি একই পরিবারে। স্বাভাবিকভাবেই মুজিবের আদর্শ, তাঁর সহজাত মানসিকতা, সাহস ও আত্মবিশ্বাসী সত্তা দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। সেই কিশোরী বয়স থেকে সর্বক্ষেত্রে স্বামী মুজিবকে সমর্থন করার মধ্যে এটি লক্ষ্য করা যায়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে তিনি প্রশ্নহীনভাবে সমর্থন দিয়েছেন; মনোবল, সাহস ও অপরিসীম প্রেরণা জুগিয়েছেন। এর সবই তিনি করে গেছেন একান্ত নিভৃতে থেকে।

বঙ্গমাতার জ্যেষ্ঠ কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলো কারান্তরালে কাটিয়েছেন বছরের পর বছর। তাঁর অবর্তমানে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা করা, দলকে সংগঠিত করা, আন্দোলন পরিচালনা করা- প্রতিটি কাজে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন বেগম মুজিব। তিনি '৬৯- এর গণঅভ্যুত্থানের বলিষ্ঠ সংগঠক ছিলেন নেপথ্যে থেকে।

তাঁর স্মরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিল। আন্দোলন চলাকালে প্রতিটি ঘটনা জেলখানায় সাক্ষাৎকারের সময় বঙ্গবন্ধুকে জানাতেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশ নিয়ে আসতেন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে সেই নির্দেশ জানাতেন। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ বাঁচিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন। আবার আওয়ামী লীগের কার্যকরী সংসদের সভা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে চলাকালে তিনি নিজের হাতে রান্নাবান্না করতেন এবং খাদ্য পরিবেশন করতেন। এ সংগঠনের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করার কাজে তাঁর অবদান অপরিসীম। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চক্ষু বাঁচিয়ে সংগঠনকে সংগঠিত করতেন; ছাত্রদের নির্দেশ দিতেন, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতেন।

মাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা লিখেছেন- "জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে আসছি, আমার বাবা কারাবন্দি। মা তাঁর মামলার জন্য উকিলদের সঙ্গে কথা বলছেন, রাজবন্দি স্বামীর জন্য রান্না করে নিয়ে যাচ্ছেন, গ্রামের শ্বশুর-শাশুড়ি ও আত্মীয়স্বজনের খবরাখবর রাখছেন। আবার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করছেন, যাঁরা বন্দি তাঁদের পরিবারের খোঁজখবর নিয়ে টাকাও পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কারাগারে দেখা করতে গিয়ে স্বামীর কাছে বাইরের সব খবর দিচ্ছেন এবং তাঁর কথাও শুনে আসছেন। কাউকে জানানোর থাকলে ডেকে জানিয়েও দিচ্ছেন। এর পর আছে তাঁর ঘর-সংসার। এর মধ্যে ছেলেমেয়েদের আবদার, লেখাপড়া, অসুস্থতা, আনন্দ-বেদনা সবকিছুর প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হয়। এতকিছুর পরও তাঁর নিজের জন্য সময় খুঁজে নিয়ে তিনি নামাজ পড়ছেন, গল্পের বই পড়ছেন, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্প করছেন।

কী ভীষণ দায়ভার বহন করছেন! ধীর-স্থির এবং প্রচণ্ড রকম সহ্যশক্তি তাঁর মধ্যে ছিল। বিপদে, দুঃখ-বেদনায় কখনও ভেঙে পড়তে দেখিনি। বরং সেখান থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজতে চেষ্টা করেছেন- এটাই ছিল তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা, তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রকাশ।

২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হতো। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে সারাদেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর আগের দিন ২২ মার্চ রাতে খেতে বসে বঙ্গবন্ধুকে চিন্তাক্লিষ্ট দেখে বেগম মুজিব জানতে চেয়েছিলেন- 'পতাকা ওড়ানোর ব্যাপারে কী কোনো সিদ্ধান্ত নিলেন?' বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'না, নিতে পারিনি। আমি পতাকা ওড়াতে চাই। একটাই ভয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এখনও ঢাকায়। পাকিস্তানিরা বলবে, আলোচনা চলা অবস্থাতেই শেখ মুজিব নতুন পতাকা উড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এ অজুহাত তুলেই তারা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সামরিক হামলা চালাবে।"

এ অবস্থায় বেগম মুজিব পরামর্শ দিয়েছিলেন, 'আপনি ছাত্রনেতাদের বলুন আপনার হাতে পতাকা তুলে দিতে। আপনি সেই পতাকা বত্রিশ নম্বরে ওড়ান। কথা উঠলে আপনি বলতে পারবেন, আপনি ছাত্র-জনতার দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন।'

স্বাধীনতার পর বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, 'আমি তোমাদের মা।' অনেক বীরাঙ্গনাকে নিজে উপস্থিত থেকে বিয়ে দিয়ে সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন জীবন দান করেন। সেই বাঙালির মা বেগম মুজিব এই দেশের জন্মের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের কণ্টকাকীর্ণ পথে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অবদান ও গুরুত্ব নিয়ে যতটা আলোচনা হওয়ার কথা, তা হয়নি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে নয়, একজন নীরব দক্ষ সংগঠক হিসেবে যিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে ভূমিকা রেখেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়সম আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন; তিনি বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। তিনি ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। এই মহীয়সী নারীর জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা।

মাহবুবউল-আলম হানিফ: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews