বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে যেমন, তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে লবণাক্ততাও। অন্যদিকে হিমালয়ের বরফ গলা জলের প্রভাবে সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক বন্যাসহ নদ-নদীর দিক পরিবর্তন এবং এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে নদীভাঙন। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের মরুকরণ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্বখ্যাত মরুভূমি গবেষকরা বাংলাদেশকে সতর্কও করে আসছেন বারবার।

দেশের এ সমস্যাগুলোকে বাংলাদেশ ‘ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান’ দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্বের অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মতো বাংলাদেশের ‘পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরির্বতন মন্ত্রণালয়’ কর্তৃক দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের চারটি মানদ- বিবেচনা করেছে। যেমনÑ এক. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দুই. প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোন অঞ্চলে বেশি হচ্ছে। তিন. কোন অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চার. ক্ষতিগ্রস্ত দেশটির ক্ষতি মোকাবিলায় বা অভিযোজনের জন্য কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কিনা।

বাংলাদেশে ঋতুভেদে আলাদা আমেজ উপভোগ করা যায়। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ছাড়াও ঋতুভেদে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, নদীভাঙন, ভূমিধস ইত্যাদি মিলিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলা হয় বাংলাদেশকে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের ঋতু চক্রের হেরফেরের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও হেরফের ঘটছে। যার প্রভাবে বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা, মরুকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশে জলবায়ুগত স্থূল পরিবর্তন সৃষ্টি করেছে।

ফলে বৃষ্টিপাত কমে গিয়ে নদ-নদীর পানি প্রবাহ শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে নদীর পানির বিশাল চাপ না থাকার কারণে সমুদ্রের লোনাপানি যতটুকু এলাকাজুড়ে আটকে থাকার কথা ততটুকু জায়গায় থাকছে না। পানিরপ্রবাহ কম থাকার কারণে সমুদ্রের লোনাপানি স্থল ভাগের কাছাকাছি চলে আসছে। ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত কম বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার সমস্যা দিন দিন আরও প্রকট হয়ে উঠছে।

এদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণ ও লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ করে নানা ধরনের পাতাখেকো কীটের আবির্ভাবও ঘটেছ। প্রশ্ন থাকতে পারে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে কীটপতঙ্গের সম্পৃক্ততা নিয়ে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে ইকোসিস্টেমের বিষয়টি। কোনো অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন হলে, সেই অঞ্চলের প্রাণিকুল অথবা কীটপতঙ্গের জীবনধারায়ও পরিবর্তন চলে আসে।

এমনও হয়, সেই অঞ্চলের প্রাণিকুলের বিলুপ্তি ঘটে নতুন প্রাণিকুলের সৃষ্টি হয়। মূলত এভাবে অত্র অঞ্চলের জলবায়ুর প্রভাবে বিভিন্ন প্রজাতির কীটের আবির্ভাব হচ্ছে। যেমনÑ সুন্দরবনেও বিভিন্ন প্রজাতির কীট জন্মেছে। আর গাছ-গাছালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
দেশীয় প্রজাতির গাছ-গাছালি হারিয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, বিদেশি গাছের আগ্রাসন। বিদেশি গাছ ও লতাগুল্মের ক্রমাগত বর্ধনের ফলে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে অন্তত হাজার খানেক প্রজাতির নিজস্ব গাছ। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, বিদেশি আগ্রাসী গাছগুলো এখন আমাদের দেশীয় প্রজাতির গাছ হিসেবে শনাক্ত হচ্ছে। যেমন- আকাশমনি, ইউক্যালিপটাস, সেগুন, মেহগনি, রেইনট্রি, বাবলা, চাম্বল, শিশু ও খয়ের গাছ। এই প্রজাতির গাছগুলোর এতটাই বিস্তৃতি ঘটেছে যে, অনেকর কাছে দেশীয় প্রজাতির গাছ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে এগুলো।

যে গাছের আগ্রাসী দাপটে দেশী প্রজাতির গাছ ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ জাতীয় গাছগুলোর জন্য প্রচুর জায়গার দরকার হয়। এগুলো দেশি গাছের তুলনায় অনেক দ্রুততার সঙ্গে মাটি থেকে বেশি পরিমাণে পুষ্টি এবং পানি শুষে নেয়। এছাড়াও আশপাশে দেশীয় প্রজাতির গাছের বেড়ে ওঠায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মূলত এ গাছগুলো ব্রিটিশ আমলে এতদ অঞ্চলে বিভিন্নভাবে আনা হয়েছে। যা আজ দেশীয় প্রজাতির জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে পড়েছে।

সুতরাং বলা যায়, আকাশমনি আর ইউক্যালিপটাস নিধন করলেই বিদেশি গাছের আগ্রাসন থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে অন্তত আরও ৯ প্রজাতির গাছের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে ‘পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়’কে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শুধু সুন্দরবনেই নয়, দেশের বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, তেমনি অনেক প্রজাতির পাখ-পাখালি, জীব-জন্তু, ফুল-ফল, গাছ-গাছালি দেশ থেকে হারিয়ে গেছে। ইউনেস্কোর ‘জলবায়ুর পরিবর্তন ও বিশ্ব ঐতিহ্যের পাঠ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবনের প্রায় ৭৫ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

নিঃসন্দেহে বলা যায়, তাতে দেশের বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ হ্রাসের কারণে পরিবেশের ওপর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনে মৎস্য খাতের ওপরেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়া, তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে দেশের মৎস্য সম্পদের জন্য প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আবার একদিকে বৃষ্টির অভাব অন্যদিকে অসময়ে ভারিবর্ষণ হওয়ায় মাছের প্রজননে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে মাছের ডিম নিজ শরীরে শোষিত হয়ে মা মাছ মারা যাচ্ছে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিকাজের ওপরেও ধারাবাহিক অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়েছে।

খরা এবং তাপমাত্রার ক্রমবৃদ্ধির কারণে বহুপ্রজাতির ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, তেমনি আগাছা, রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অঞ্চলভেদে মাটির উপাদানে তারতম্য ঘটছে এবং কাক্সিক্ষত ফসল উৎপাদনেও ব্যাহত হচ্ছেন কৃষক। এছাড়াও বোরো উৎপাদনে প্রচুর সেচের পানির প্রয়োজন পড়ে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জমিগুলোতে লবণাক্ততার কারণে সেচেও বিপত্তি ঘটছে। আবার লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে চিড়িং চাষেও ব্যাপক ধস নেমেছে।

অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলে সেচের পানিতে আরেক বিপত্তি ঘটছে। সেখানকার ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেশি হওয়ায় ফসলের মাধ্যমে তা মানবদেহে প্রবেশ করছে। এছাড়াও উত্তরাঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পর্যাপ্ত পানি ফসলের ক্ষেতে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। যার কারণে ফসল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার নিচে নেমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে আমরা বলতে পারি জলবায়ু পরিবর্তন রোধ না হলে শুধু দেশের নি¤œাঞ্চলই প্লাবিত হবে না, মরুকরণ ঝুঁকিতেও পড়বে।

অন্যদিকে এর প্রভাব পড়বে আমাদের বনজ ও কৃষিজ সম্পদের ওপরেও। যে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া তখন অনেক কঠিন হয়ে যাবে। সুতরাং নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে নিজেরাই সচেষ্ট হতে হবে। নদীদূষণ রোধের পাশাপাশি ফিরিয়ে আনতে হবে নদীর নাব্য। দেশের আনাচে-কানাচে সৃষ্টি করতে হবে বনায়ন। আগ্রাসী গাছগুলো কেটে ফেলতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতি। পরিবেশ বা বায়ুদূষণ ঘটে এমন ধরনের কাজকর্ম করা যাবে না। সর্বোপরি শিল্পোন্নত দেশগুলোর কাছে প্রামাণ্য চিত্রসহ আমাদের আর্জি তুলে ধরতে হবে। তাহলে রাতারাতি জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা সম্ভব না হলেও আমরা যথেষ্ট উপকৃত হব। 

লেখক : কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক লেখক



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews