দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা ক্রমেই লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। সাগরের পানি প্রবেশ করে কৃষিজমি ধীরে ধীরে লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে। লবণাক্ততা ঠেকাতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে এ এলাকায় পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয়সহ এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। লবণাক্ততা এখানকার মানুষের কাছে এখন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের তীব্র খাদ্য সংকট মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এক দশক আগেও যারা নিজের জমিতে চাষবাস করে খাদ্য সংস্থান করত, এখন তাদের খাদ্য কিনে জীবনধারণ করতে হচ্ছে। তাদের জীবনাচার বদলে গেছে। জমিতে ধান চাষের বিষয়টি তাদের কাছে এখন শুধুই স্মৃতি। লবণাক্ততার এ অভিশাপ যতটা না প্রাকৃতিক, তার চেয়ে বেশি মনুষ্যসৃষ্ট। প্রতিকারহীনতাও এজন্য অনেকাংশে দায়ী। প্রাকৃতিসৃষ্ট লবণাক্ততার মধ্যে নদীর স্বাভাবিক স্রোত ও নাব্য কমে যাওয়া, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সমুদ্রের জোয়ারের লবণাক্ত পানি ভূ-ভাগে প্রবেশ করে বের হতে না পারা উল্লেখযোগ্য। মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, কৃষিজমিতে নির্বিচারে চিংড়ি ঘের নির্মাণ এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি কর্তৃক নদী ও খাল দখল করা। এসব কারণ লবণাক্ততা বৃদ্ধিকে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে উপনীত করেছে। পরিস্থিতি এতটাই উদ্বেগজনক যে, মহাপরিকল্পনা ও তার দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিরাট এলাকা অচিরেই বিরাণভূমিতে পরিণত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন ধরনের বিচলন আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না।
লবণাক্ততা বৃদ্ধি পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে ‘ফুড বায়িং জোন’-এ পরিণত করেছে বলে স্থানীয় লোকজন এবং সংশ্লিষ্ট কৃষিবিদরা স্পষ্ট করেই বলেছেন। মংলা উপজেলার কৃষি অফিসার স্বীকার করেছেন, এ অঞ্চলের মানুষ কৃষির পরিবর্তে বাজারনির্ভর হয়ে গেছে। এক দশক আগেও মানুষকে ধান-চাল কিনে খেতে হতো না। ক্রমাগত লবণাক্ততা বৃদ্ধিতে কৃষক কৃষিজমি হারিয়ে ফেলেছে। লবণাক্ততা এতটাই তীব্র যে শুধু ধান নয়, নারিকেল, সুপারি এমনকি পশুখাদ্য ঘাসও জন্মাতে পারছে না। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত লবণাক্ততাসহিষ্ণু ধান চাষ করেও কৃষক কোন ফল পাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে এবং নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে শুধু পরিবেশের ভয়াবহ বিপর্যয়ই ঘটবে না, উপকূলীয় ব্যাপক জনগোষ্ঠীর খাদ্যসংকটের পাশাপাশি বেকার হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। মিঠা পানির অভাবে শিল্পকারখানাও সংকটে পড়বে। এ সমস্যা দেশের অর্থনীতির উপর বাড়তি যে চাপ সৃষ্টি করবে তা সামাল দেয়া মুশকিল হয়ে পড়বে। লবণাক্ততা কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতের পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি তীব্র আকার ধারণ করে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তবে ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ভূ-ভাগে প্রবেশকৃত সাগরের নোনা পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে পারলে লবণাক্ততা এতটা তীব্র আকার ধারণ করতো না। ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়াও উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধির স্থায়ী কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিন্ন নদ-নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক থাকলে সমুদ্রের নোনা পানি কোনভাবেই ভূ-ভাগে প্রবেশ করতে পারত না। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারে একদিকে দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া চলছে, অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল লবণাক্ততার শিকার হচ্ছে। ভারতের এ ধরনের আচরণ প্রতিবেশীসুলভ না হলেও সে বছরের পর বছর ধরে এ কাজটিই করে চলেছে। এর বিপরীতে নদীর স্রোত ও গতিপথ ঠিক রাখতে বড় বড় প্রকল্পের কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তা খুব একটা কার্যকর রূপ লাভ করেনি। ড্রেজিংয়ের নামে যে কর্মকা- চলছে, তা নদীর নাব্য বৃদ্ধিতে খুব একটা সহায়ক হচ্ছে না।  উল্টো শত শত কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে লোপাট হচ্ছে। বলা যায়, নদী শাসনব্যবস্থা নিয়ে এক ধরনের অব্যবস্থাপনাই দৃশ্যমান। নদ-নদীর স্বাভাবিক গতিধারা না থাকা লবণাক্ততার অন্যতম কারণ হলেও, চিংড়ি ঘেরও কম দায়ী নয়। অভিযোগ রয়েছে, চিংড়ি ঘের মালিকরা তাদের ব্যবসা প্রসারের জন্য কৃষকদের উপর প্রভাব খাটিয়ে কৃষিজমি বিক্রি করতে বাধ্য করছে। যারা বিক্রি করতে চায় না, তাদের জমিতে কৌশলে সাগরের নোনা পানি প্রবেশ করিয়ে বাঁধ দিয়ে ধরে রাখছে। চিংড়ি ঘের মালিকদের এ ধরনের জবরদস্তিমূলক কর্মকা- চলতে থাকলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি কোনভাবেই কমানো যাবে না।
লবণাক্ততা  হ্রাস ও নিয়ন্ত্রণে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের বিকল্প নেই। লবণাক্ততার কারণে কৃষিজমি হ্রাস, অনুর্বর এবং মানুষ বেকার হওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। যেসব জমি ইতোমধ্যে লবণাক্ততার কবলে পড়েছে, সেসব জমিতে লবণসহিষ্ণু উন্নত প্রজাতির ধান উদ্ভাবন করে কৃষকদের সহায়তা দেয়ার কাজটি দ্রুত করা আবশ্যক। কৃষিজমিতে যাতে কোনভাবেই চিংড়ি ঘের গড়ে না উঠে, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে সাগরের সুবিধাজনক এলাকায় চিংড়ি চাষের ব্যবস্থা করতে হবে। নদ-নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে এবং পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে ভারতের সাথে বাস্তবোচিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ভারত আমাদের কাছ থেকে অনেক সুবিধা আদায় করে নিয়েছে এবং এখনও নিচ্ছে। তার কাছ থেকেও আমাদের সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিতে হবে। নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে নদী ব্যবস্থাপনাকে যুগোপযোগী করে ঢেলে সাজানো এবং তার বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।





Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews