আমার শিক্ষাজীবনের একটি অংশ আমি কাটিয়েছি জাপানে। আইচি বিভাগের তয়োহাসি শহরের একটি বিশ্ববিদ‍্যালয়ে তখন অনার্স পড়ছিলাম। অন‍্যান‍্য ছাত্রদের মতো গ্রীষ্মের ছুটিতে পার্টটাইম কাজ করে পড়াশুনার কিছু খরচ তুলতে হতো।

সেই সময়ে পার্টটাইমের কাজে টয়োটা গাড়ির প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হয়েছিল। কিছুদিন কাজ করে বুঝতে পারলাম, অন‍্যান‍্য প্রতিষ্ঠান থেকে একদমই আলাদা এই টয়োটা। যদিও জাপানের সব প্রতিষ্ঠানই খুব সিস্টেমিটিকভাবে পরিচালিত হয়। কিন্তু তারপরেও টয়োটা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে মনে হয়েছে, তা আরও যেন একটু বেশিই সাংগঠনিক। যে বেল্টগুলিতে গাড়িগুলি তৈরি হয়, সেখানে ইঞ্জিনিয়াররা গাড়ির পার্টসগুলি একত্রিত করে। কি অদ্ভুতভাবে শৈল্পিক কায়দায় পার্টসগুলি সংযুক্ত করে গাড়ি তৈরি করে তা দেখে সত‍্যিই অবাক হতাম। তবে সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলাম, কোন সমস‍্যাকে তারা কিভাবে দলবদ্ধভাবে সমাধান করে তা দেখে। যখনই কোন বেল্টে সমস‍্যা দেখা দিত, তখনই সেই ইঞ্জিনিয়ার সমস‍্যাটি নিজের মধ‍্যে না রেখে, টিমের সবাইকে জানিয়ে দিত। সঙ্গে সঙ্গে টিমের অন‍্যান‍্যরা সেই সমস‍্যাটি সমাধান করবার জন‍্য এগিয়ে আসত। সমস‍্যাটি কারও ‘নিজস্ব’ নয়, তা যেন টিমের সবার। এইভাবেই সমস‍্যাটিকে তারা সমাধান করত। যে সমস‍্যাটি রিপোর্ট করতো, সে কখনই ব‍্যাপারটি তার দুর্বলতা বা ভুল, সেভাবে মনে করত না।

যে কোন প্রোজেক্টে কাজ করতে গেলে সমস‍্যা হবেই, তাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমস‍্যাকে নিজের মধ‍্যে না রেখে তা সবার মধ‍্যে শেয়ার করে নিতে হয়। একইরকমভাবে অন‍্যান‍্য দেশেও গাড়ি তৈরি হয়, কিন্তু দেখা গেছে তাদের তৈরি করা গাড়িতে জাপানিজ গাড়ি থেকে ত্রুটি বেশি থাকে, তৈরি হতেও বেশি সময় লাগে।

মনে করা যাক, ইউরোপে যখন এই গাড়িগুলি তৈরি হয়, তখন কেউ কোন সমস‍্যা পেলে তা ইঞ্জিনিয়ার গাড়িটির লগবুকে রেকর্ড করে রাখে। এ ছাড়াও একদল লোক থাকে, যাদের কাজই হল সমস‍্যাগুলি খুঁজে বেড়ানো। যখন তারা সমস‍্যাকে চিহ্নিত করে, তখনই তারা তা লগে রিপোর্ট করে রাখে। পরবর্তীতে একদল ইঞ্জিনিয়ার কাজ করে সেই সমস‍্যাগুলি সমাধান করার।

কিন্তু পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোন সমস‍্যা পরবর্তীতে সমাধান করতে গেলে তার জন‍্য আরও বেশি শ্রম ও রিসোর্স ব‍্যবহার করতে হয়। প্রথমেই সমস‍্যাটি সমাধান করতে পারলে, তুলনামুলকভাবে কম রিসোর্স ব‍্যবহৃত হয় এবং সময় কম লাগে। অনেকে ভাবতে পারেন যে মূল প্রডাক্ট তৈরির ক্ষেত্রে এইভাবে সমস‍্যার সমাধান করতে গেলে আরও একটু বেশিই সময় লাগতে পারে। কিন্তু পুরো প্রোডাক্টটি তৈরির সময়কে আমরা যদি বিচার করি তবে দেখবো, সমস‍্যাটি উপলব্ধি করার সঙ্গে সঙ্গেই সমাধান করলেই বেশি উপকার পাই। এই ক্ষেত্রে দলগত কাজ করার সাংগঠনিক শক্তিটি আরও বেশি পোক্ত হয়।

এবার গাড়ির কথা থেকে সফটওয়‍্যার তৈরির কথায় আসা যাক। যখনই আমি কোন প্রজেক্ট শুরু করি তখন প্রথমেই আমি আমার টিমকে এই টয়োটা গাড়ির সমস‍্যা সমাধানের গল্পটি বলি। আমাদের কাজ করবার বোর্ডে আমি সব সময় একটি আলাদা জায়গা বা কলাম রাখি, যাকে আমি ‘বাগ বোর্ড’ বলি। যখনই কোন ইঞ্জিনিয়ার কোন সমস‍্যা খুজে পায়, যেখানে অন‍্যের সাহায‍্য লাগবে, তখনই আমরা সেই জায়গাটিতে লিখে টিমের সবাইকে জানিয়ে দিই। অন‍্যান‍্য কাজের পাশাপাশি আমরা সেই সমস‍্যাটিকে সমাধান করার জন‍্য টিমের সবাই মিলে কাজ করি। তবে বেশিরভাগ সময়েই দেখেছি, টিমের কেউ না কেউ সেই সমস‍্যাটি সমাধান করার উপায়টি জানে। সে সমাধানের উপায় জানিয়ে দেয় কিংবা সমাধান করে দেয়। এইভাবে দ্রুত সেই বাগগুলি আমরা টিমের সবাই মিলে সমাধান করি। তবে কিছু কিছু বাগ আমরা পাই যেটি সমাধান করতে গেলে আমাদের বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। এবং মূল সফটওয়‍্যার তৈরির প্লানটি পরিবর্তীত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে টিমের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিই কীভাবে তা সমাধান করা যায়।

টিমের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলে টিমের একটি ধারণা হয় যে প্রজেক্টটি তারাই চালাচ্ছে। এই উপলব্ধি করাতে পারলে প্রজেক্টটি সঠিক সময়ে শেষ হয়। একজন ম‍্যানেজার হিসাবে সবার কাজে খবরদারি করছি, এই ধারণাটির থেকে টিমের সবাই মিলে ‘আমরা’ কাজ করছি এই বোধদয় বেশি জরুরি। জোর করে কাউকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেবার থেকে, কেউ স্বতস্ফুর্তভাবে কাজ করলে বেশি আউটপুট পাওয়া যায়। তাই আমি চেষ্টা করি টিমের মধ‍্যে ‘আমরা’ এর উপলব্ধি আনার। টয়োটার সমস‍্যা সমাধানে টিম স্পিরিটটি কাজে লাগানোর অভিজ্ঞতাকে আমি ব‍্যবহার করি আমার প্রোজেক্ট ম‍্যানেজমেন্টে। 

(সফটওয়‍্যার তৈরির প্রজেক্টগুলি ম‍্যানেজ করতে যেয়ে যেসব অভিজ্ঞতা হয়, তারই একাংশ পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করাই এই ডায়েরির উদ্দেশ‍্য।)

লেখক: ড. মশিউর রহমান, সিঙ্গাপুর

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews