গত ক’দিন ধরে সুইজারল্যান্ড চষে বেড়াচ্ছি। যতই দেখছি, ততই বিস্মিত হচ্ছি। নানা জাতি ও নানা বর্ণের মানুষ এখানে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছে। অঞ্চলভেদে ভাষারও ভিন্নতা চোখে পড়ে। কোথাও ফরাসি, কোথাও জার্মান, কোথাও ইতালিয়ান। তবে লক্ষ্যণীয়, ছোট-বড় সব শহরেই বাংলাভাষী অভিবাসীর দেখা মিলবেই। এখানে আয়-রোজগার ইউরোপের অন্যান্য দেশের চাইতে ভালো। মান সম্পন্ন আবাসন, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা সব মিলিয়ে এখানকার নাগরিক জীবন পরিশীলিত আর শান্ত।
সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্ন (Berne) নামমাত্র রাজধানী। আসল প্রশাসনিক কেন্দ্র জেনেভা, আর বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র হলো জুরিখ। আল্পস পর্বতমালা ঘেরা এ দেশ যেন প্রকৃতির হাতে আঁকা এক বিস্ময়চিত্র।
দেশটির পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত জেনেভা। এখানে জাতিসংঘের দফতর, রেডক্রসের সদর দফতর এবং শরণার্থী সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিস মিলিয়ে শহরটি কূটনীতিক, সাংবাদিক এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মিলনকেন্দ্র। শুধু রাজনৈতিক গুরুত্বই নয়, জেনেভা প্রকৃতির সৌন্দর্যেও ভরপুর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লাখো লাখো পর্যটক মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে এ শহরের অলিগলি।
লেক জেনেভা-র তীরে দাঁড়িয়ে যখন দৃষ্টি যায় আকাশছোঁয়া ফোয়ারার দিকে (Jet d’Eau), তখন মনে হয় প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সৃষ্টির এক অনন্য মিলন ঘটেছে। হ্রদের চারপাশে গড়ে উঠেছে বাগান, ভাস্কর্য আর ব্যস্ত রেস্তোরাঁ।
জেনেভার Old Town বা পুরাতন শহর সরু পাথুরে রাস্তা, প্রাচীন ক্যাথেড্রাল ও চমৎকার কফিশপে ভরা। এখানে দাঁড়ালে মনে হয় সময় যেন থমকে গেছে।
লেকের ওপারে ফরাসি অঞ্চল। নৌকায় চেপে কয়েক ঘণ্টার সফরে সেখানে গিয়ে কফি কিংবা লাঞ্চ সেরে আসা যায়।
এই শহরে চলাচলের জন্য একদিনের ডে পাস কিনলেই ট্রাম, বাস, মেট্রো কিংবা রেলে ঘুরে দেখা যায় পুরো অঞ্চল। জেনেভার ট্রেন সার্ভিস এতটাই সময়নিষ্ঠ ও আরামদায়ক যে যাত্রাটাই যেন ভ্রমণের অংশ হয়ে ওঠে।
লেক জেনেভার ধারে আরেকটি শহর মন্ট্রো (Montreux), যা জ্যাজ ফেস্টিভ্যালের জন্য বিখ্যাত। এখানে বেশ কিছু বাংলাদেশি অভিবাসী বসবাস করেন। তাঁদের একজন, ‘ইন্ডিয়ান প্যালেস রেস্টুরেন্ট’ (Restaurant Palais Indien)-এর মালিক মহিউদ্দিন, আমাদের নৈশভোজে আপ্যায়িত করলেন। তাঁর কাছ থেকে শুনলাম সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশি অভিবাসীদের জীবন সংগ্রাম আর অভিযোজনের গল্প।
সুইজারল্যান্ড এসে ইন্টারলেকেন না ঘুরলে ভ্রমণ অসম্পূর্ণই থেকে যায়। নামের মতোই, শহরটি দু’টি হ্রদ (Lake Thun ও Lake Brienz)-এর মাঝে অবস্থিত। পাহাড়ি উপত্যকার কোলে এমন এক জায়গা, যাকে মনে হয় আল্পসের বুকের ভেতর প্রকৃতি গোপনে লুকিয়ে রাখা স্বপ্নপুরী।
পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা ছবির মতো গ্রাম, তৃণভূমি আর চারণভূমি আগে শুধু ছবিতে দেখেছি আজ স্বচক্ষে দেখে সত্যিই মুগ্ধ হলাম।
ইন্টারলেকেনকে বলা হয় সুইজারল্যান্ডের অ্যাডভেঞ্চারের রাজধানী। পাহাড়ি ট্রেন, কেবল কার, প্যারাগ্লাইডিং, স্কিইং তথা সব মিলিয়ে রোমাঞ্চপ্রেমীদের স্বর্গ। এখানেই রয়েছে ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু রেলস্টেশন জুঙফ্রাউইয়োখ (Jungfraujoch)।
শহরের চারপাশে হাঁটলেই বোঝা যায় এর সৌন্দর্য কতটা অনন্য। সন্ধ্যার আলোয় হ্রদের জলে পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি যেন স্বপ্ন থেকে উঠে আসা দৃশ্য।
জুরিখকে বলা হয় “সুইজারল্যান্ডের অর্থনৈতিক রাজধানী”। এটি দেশের সবচেয়ে বড় শহর। একদিকে আধুনিক স্থাপত্য আর ব্যস্ত ব্যবসা, অন্যদিকে ইতিহাস আর ঐতিহ্যে ভরপুর। তবে জুরিখের আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে Zurich Lake-এর ধারে। নীল জলের হ্রদ, দূরের বরফঢাকা পাহাড় আর ছোট ছোট নৌকা; সব মিলিয়ে শহরটিকে এক কবিতার আবহ দেয়।
জুরিখ থেকে প্রায় এক ঘণ্টা ড্রাইভের পথ রাইন ফলস (Rhine Falls)-এ। এটি ইউরোপের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত। দূর থেকে দেখলেও যেমন অপূর্ব লাগে, কাছে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হয় প্রকৃতির অদম্য শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
রাতের খাবারের নিমন্ত্রণ ছিল ফেঞ্চুগঞ্জ এনজিএফএফ স্কুলের সাবেক ছাত্রী সেলিমার বাসায়। আমার সফরসঙ্গী কথাসাহিত্যিক সিরাজুল ইসলাম মুনিরের সুবাদে আমি আমন্ত্রিত হই। এই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের নেটওয়ার্কটি বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত। সেলিমা ও তাঁর স্বামী রতন বহু বছর ধরে জুরিখে বসবাস করছেন। তাঁদের কাছ থেকে জানতে পারলাম সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশি কমিউনিটির বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কথা।
আরেকজন প্রবাসী, তামজিদ, আমাদের সারাদিন ঘুরিয়েছেন। জুরিখে তাঁর একটি বড় প্রিন্টিং ব্যবসা রয়েছে। চলার পথে তিনি আমাদের শোনালেন অভিবাসী জীবনের সুখ-দুঃখের নানা গল্প। সেসব গল্প একদিন আলাদা করে লেখার ইচ্ছে রইল।
পৃথিবীখ্যাত সুইস চকলেটের জন্ম এদেশেই। ১৯ শতকের শুরুর দিকে এখানকার চকলেট প্রস্তুতকারীরা দুধ মিশিয়ে তৈরি করেছিলেন মিল্ক চকলেট, যা পরে বিশ্বজোড়া খ্যাতি পায়।
আজকের দিনে সুইস চকলেট কেবল খাবার নয়, এটি সুইজারল্যান্ডের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির অংশ। Lindt, Toblerone, Cailler প্রভৃতি ব্র্যান্ড বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। প্রতিটি শহরে ছোট ছোট চকলেট বুটিক রয়েছে, যেখানে গিয়ে স্থানীয়ভাবে তৈরি হাতে বানানো চকলেটের স্বাদ নেওয়া যায়।
চকলেট টেস্টিং ট্যুরে অংশ নিলে বোঝা যায়, এখানে চকলেট তৈরির প্রক্রিয়া কত যত্নের সঙ্গে করা হয়। চকলেটের এক টুকরো মুখে দিলেই মোলায়েম স্বাদ যেন ভ্রমণের ক্লান্তি মুহূর্তেই ভুলিয়ে দেয়। বলা যায়, সুইস চকলেট শুধু মিষ্টান্ন নয়, এটি এক আবেগ, যা দেশটির পরিচিতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে।