এএফসি অনূর্ধ্ব বাছাইপর্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া মেয়েদের হাতে ১০ লাখ টাকার সঙ্গে একটি করে শাড়িও তুলে দিয়েছেন মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শামসুন্নাহার কার হাতে তুলে দেবে এই শাড়ি?

লাল একটি শাড়ি! এরই আঁচলে লুকিয়ে আছে মমতা আর ভাঁজে ভাঁজে জড়ানো ১৬ বছরের এক মেয়ের আফসোস, কষ্ট ও ভালোবাসা...

এএফসি অনূর্ধ্ব ১৬ বাছাইপর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় বাংলাদেশ দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়ের হাতে ১০ লাখ টাকা তুলে দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রী চ্যাম্পিয়ন মেয়েদের মায়েদের সম্মান জানানোর জন্য প্রত্যেক খেলোয়াড়ের কাছে মায়ের জন্য তুলে দিয়েছেন একটি করে লাল শাড়ি। মারিয়া মান্দা, ধুপনা চাকমারা হয়তো বাড়ি ফিরে মাকে বলবে, ‘দেখ মা, তোমার মেয়ে কী নিয়ে এসেছে তোমার জন্য।’ সযত্নে শাড়িটা তুলে দেবে মায়ের হাতে, আর হাসবে। শামসুন্নাহার মমতামাখা এ শাড়ি কার হাতে তুলে দেবে?

শামসুন্নাহারের বয়স তখন আট কী নয়। ২০১১ সালের এক দুপুরের কথা মনে পড়ে তার। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে মায়ের নিথর দেহ বাড়িতে যখন নিয়ে আসা হলো, সেদিন শুধু মায়ের নিথর মুখটার দিকেই চেয়েছিল তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া শামসুন্নাহার। সারা বাড়িজুড়ে কান্নার রোল। বড় ভাইবোনেরা ‘মা...মা’ বলে মাতম করছেন। সাত ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম শামসুন্নাহার তখন বুঝে গিয়েছিল, প্রশান্তি আঁকা মুখ নিয়ে শুয়ে থাকলেও মায়ের আর ঘুম ভাঙবে না, আর কখনোই তার মুখে তুলে দেবেন না ঝোলমাখা ভাত।

সাত বছর পেরিয়ে গিয়েছে। একটু একটু করে সেই শোকও কাটিয়ে উঠেছে শামসুন্নাহার। মাঝেসাজে মায়ের কথা মনে হলে আকাশের দিকে তাকিয়ে মা-কে খুঁজে মেয়েটি। কিন্তু গত পাঁচ দিন বড্ড মনে পড়ছে মাকে। খুব করে খুঁজছে মাকে। তাঁর হাতে যে তুলে দিতে হবে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া লাল শাড়ি।

আবেগকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বাস্তবতায় ফিরে আসে ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার মুক্তাগাছার মেয়ে। এ শাড়িটা কখনোই নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাবে না, শাড়িটি তুলে দেওয়া হবে না মায়ের হাতে। এটা জানা আছে বলেই কষ্ট, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া উপহারের মধ্যে যখন শাড়িটি দেখেছি। তখন খুব খারাপ লেগেছে। সবাই তো তার মাকে শাড়িটা নিয়ে দেবে। আমার তো মা নেই, আমি কাকে দেব।’ বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে উঠে শামসুন্নাহারের। চোখের কোনাটাও চিকচিক করে ওঠে তার। তবে এই শাড়িতেই নবম শ্রেণিতে পড়া মেয়েটি খুঁজে নিচ্ছে ভালোবাসা। শাড়িটা কাছে থাকা মানে যে তার কাছে বিশেষ কিছু, ‘শাড়িটা আমি কাউকেই দেব না। সব সময় আমার কাছেই রেখে দেব। মনে হবে মা তো আমার সঙ্গেই আছেন।’

সাত বছর আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও মা-মেয়ের কথা তো হয় প্রতিদিনই। লাল-সবুজ জার্সিটা গায়ে চাপানোর সময় শামসুন্নাহারের মনে হয়, তাঁর মা যেন পাশ থেকে বলেছে, ‘ভালো করে খেলিস মা।’ আর দলের আক্রমণভাগের দায়িত্ব বুঝে নেওয়া মেয়ে একজনের পর একজনকে কাটিয়ে প্রতিপক্ষ রক্ষণভাগ কাঁপিয়ে দেয়। তার শট জালে পৌঁছালে উল্লাস করে পুরো বাংলাদেশ।

বয়সভিত্তিক সবগুলো জাতীয় দলের সঙ্গেই এখন জড়িয়ে আছে শামসুন্নাহারের নাম। গত মাসে এএফসি অনূর্ধ্ব ১৬ দলের হয়ে বাছাইপর্বের অপরাজিত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এর আগে গত বছর অনূর্ধ্ব ১৫ দলের হয়ে ঘরের মাঠে জিতেছে সাফ। তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে হংকংয়েও। সেখানে জকি ক্লাব চার জাতি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেছিল ১৫ বছরের মেয়েটি। শামসুন্নাহারের আফসোস মা তার এই অর্জনগুলো দেখে যেতে পারল না। আজ প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নেয় মেয়ে, পত্রিকায় ছবি আসে—মায়ের চেয়ে বেশি আর কেই-বা খুশি হতেন!

ফুটবলার শামসুন্নাহার। ফাইল ছবিকলসিন্দুরে বেড়ে ওঠার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই ফুটবলে হাতেখড়ি শামসুন্নাহারের। রক্ষণশীল পরিবার হওয়ায় বাবা কখনোই চাননি মেয়ে খেলাধুলা করুক। মায়েরও ছিল বাধা। কিন্তু বঙ্গমাতা গোল্ডকাপে একটি শিরোপা জয় করেই ভেঙেছিল মায়ের বাধার শিকল। এরপর থেকে মা-ই ছিলেন শামসুন্নাহারের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণার নাম, ‘মা প্রথমে খেলা পছন্দ করত না। কিন্তু বঙ্গমাতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে আমাদের দল ১ লাখ টাকা পুরস্কার পায়। আমরা প্রত্যেকে ৫ হাজার করে পেয়েছিলাম। আমি সেই টাকা মায়ের হাতে তুলে দেওয়ায় খুব খুশি হয়েছিলেন। পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে বলেছিলেন আমার টাকা পাওয়ার কথা।’

শুক্রবার শামসুন্নাহার ১০ লাখ টাকার চেক পেয়েছে। কিন্তু ওই যে শাড়ির মতো ফিরে এল সেই পুরোনো কষ্ট, টাকাগুলো মায়ের হাতে তুলে দিতে না পারার কষ্ট, ‘মা বেঁচে থাকলে টাকাটা মায়ের হাতে তুলে দিতাম। মা কত খুশি হতেন। গর্ব করতেন।’

বাবা থেকেও প্রায় না থাকার মতোই! সাড়ে পাঁচ বছর ধরে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ঘরে পড়ে আছেন বাবা নেকবর আলী। মাঝেমধ্যে ময়মনসিংহ শহরে এসে ডাক্তার দেখিয়ে আবার সেই গ্রামে ফিরে গিয়ে ঘরেই শুয়ে থাকা হয় তাঁর। প্রতি শুক্রবার অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন কখন ফোন দেবে তাঁর ছোট শামসুন্নাহার, ‘ওর কাছে তো ফোন থাকে না। প্রতি শুক্রবারে ফোন দিয়ে আমার খোঁজখবর নেয়। আমি কী খাইছি-না খাইছি জানতে চায়। টাকা পেয়েই জানাইছে। আমি বলছি তোমার নামে কিছু জমি কিনে দেব।’নেকবর আলী বুঝতে পারেন, তাঁর মেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে। এখন মেয়েই তাঁর খোঁজখবর নেয়। ওষুধ খাওয়া, ঘুম হওয়া-না হওয়ার হিসেব এখন দিতে হয় মেয়ের কাছে।

কিন্তু ‘বড়’ হয়ে ওঠা মেয়েটি এখনো যে গভীর রাতে মাকে স্বপ্নে দেখে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে সেটা হয়তো জানা হয় না তাঁর। বারান্দায় এসে তখন উদাস দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মাকে খোঁজার কষ্টের কথা হয়তো বাবাকে জানাতে বাধে বড় হতে বাধ্য হওয়া মেয়েটির। এখন অবশ্য একটি অবলম্বন পেয়েছে সে। মমতামাখা লাল শাড়িটির মধ্যেই হয়তো মাকে খুঁজে নেবে শামসুন্নাহার!

আরও পড়ুন:

জানতে পারেন আনাই মগিনি ও আনুচিং মগিনির গল্পটিও 



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews