জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন, কৃষি, শিল্প, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মূলত বিশ্বে করোনা ও যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি এক মহাসংকটে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে শুধু সরকারি পর্যায়ে নয়, ব্যক্তি পর্যায়ে সতর্কতা অবলম্বন ব্যতীত বাংলাদেশের জ্বালানি সমস্যার সমাধানের আর কোনো বিকল্প উপায় আছে বলে মনে হয় না।

জ্বালানি শক্তির গুরুত্বপূর্ণ উৎস বিদ্যুৎ। এই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তেল, কয়লা এবং প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা হয়, যা একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক সাফল্যের তাৎপর্যপূর্ণ সূচক। একদশক আগেও, ‘লোডশেডিং’ শব্দটি আমাদের কাছে অতি পরিচিত ছিল। তবে বর্তমান সরকারের সাফল্যের কারণে এই লোডশেডিং শব্দটি ছিল বিলুপ্তির পথে। এখন রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আবার সংকট দেখা দিয়েছে।

বৈশ্বিক বাজারে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মৌলিক জ্বালানি সরবরাহ হ্রাসের কারণে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ইতিমধ্যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য লোডশেডিংয়ের সমস্যাটি আবার একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে পীড়াদায়ক গ্রীষ্মের তাপ ও তীব্র দাবদাহ আরো বেড়ে গেছে। এই সমস্যা সমাধানে প্রশাসন বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও তা কত দিন চলবে তা কেউই ধারণা করতে পারছে না। তাই বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

বিদ্যুৎ কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় বরং এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পদ। তাই, এই অবস্থার সমাধানের জন্য এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা ব্যতীত এই সম্মিলিত সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে না। এ ব্যাপারে সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা মাথায় রেখে আমাদের সবার সচেতন হওয়া উচিত। এ অবস্থায় বিদ্যুতের অপচয় বন্ধের বিকল্প নেই। যদি বিদ্যুৎ ব্যবহারের অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করা হয়, তাহলে বিদ্যুতের মোট চাহিদা তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেতে পারে। এমতাবস্থায়, আমাদের প্রথম পদক্ষেপটি হতে পারে যে কোনো এলাকায় বিদ্যুতের অপব্যবহার হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখা বা ব্যবহার সীমিত করা। বিদ্যুতের বিকল্প উৎসও আমাদের খুঁজতে হবে। প্রযুক্তির ওপর আমাদের অত্যধিক নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

আমরা মনে করি, ব্যক্তিপর্যায়ে নিম্নলিখিত কাজগুলি করার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য হারে বিদ্যুতের অপচয় রোধ বা হ্রাস করা সম্ভব : ১. মাইক্রোওয়েভ, রাইস কুকার এবং কারি কুকার যথাসম্ভব কম ব্যবহার করা এবং একেবারে প্রয়োজন না হলে ফ্যান, লাইট, পিসি, ওভেন ইত্যাদি চালু না করা। ২. প্রয়োজন না হলে দেওয়ালের বিভিন্ন জায়গায় চার্জার লাগানো এড়িয়ে চলা। ৩. নষ্ট বৈদ্যুতিক সংযোগ মেরামত করা। ৪. বৈদ্যুতিক পাখা এবং আলো ব্যবহারে ইলেকট্রনিকস নিয়ন্ত্রক ব্যবহার করা। ৫. শক্তিসাশ্রয়ী বাল্ব ব্যবহার করা। ৬. যেহেতু এসির তুলনায় ফ্যানে বিদ্যুৎ কম লাগে, তাই অদূর ভবিষ্যতে ফ্যান ব্যবহার করার কথা মাথায় রাখা। ৭. ঘরের দরজা-জানালা খোলা রেখে দিনের আলোর সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা এবং দিনের বেলা আলো ব্যবহার এড়িয়ে চলা।

তাছাড়া, যখন-তখন পোশাক শুকানোর জন্য ওয়াশিং মেশিন, হেয়ার ড্রায়ার বা ফ্যান ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে সূর্যালোক এবং সৌরশক্তির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি জরুরি। পানি গরম করার জন্য হিটার বা গিজারের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করা, দিনের আলোর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া, উত্সবের আলো হ্রাস করা এবং শপিং সেন্টার, মার্কেট, রেস্তোরাঁ ইত্যাদিতে বিদ্যুতের অপব্যয় রোধ করাও এই মুহূর্তে আমাদের একান্ত করণীয়।

দিনের আলোতে মোমবাতি জ্বালানো উচিত নয়। একইভাবে দিনে সড়কের বাতি যেন না জ্বলে সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে। স্থানীয় সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের তা অবহিত করে বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের লেখা একটি বাংলা কবিতার একটি বিখ্যাত উদ্ধৃতির কথা না বললেই নয়। কবি লিখেছেন, ‘যেজন দিবসে মনের হরষে/ জ্বালায় মোমের বাতি, আশু গৃহে তার দেখিবে না আর/ নিশীথে প্রদীপ ভাতি!’ শিক্ষাজীবনে এই কবিতার লাইনটি পড়ে আমরা যা শিখেছি, বাস্তবে তা অনুশীলন করার সঠিক সময় এখন। তা না হলে বর্তমান বিদ্যুতের সংকট আমরা আর বেশিদিন সহ্য করতে পারব না। এছাড়াও, আরো বেশি বিদ্যুত্বিভ্রাট দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। দুঃখের বিষয়, কীভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হয় সে বিষয়ে সরকারের অসংখ্য সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও আমরা নিষ্ক্রিয় হয়েই আছি। এই উদাসীনতার প্রাথমিক কারণগুলি হলো আমাদের আরামপ্রিয় মানসিকতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার। যাহোক, অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য এই মুহূর্তে অনেক সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থায় আমাদের বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়া উচিত!

একই সঙ্গে শুধু আমাদের একা সচেতন হলেই চলবে না। যদি সম্ভব হয়, পরিচিত, প্রতিবেশী এবং পরিবারের সদস্যদের জাতীয় অর্থনীতিতে বিদ্যুৎ অপচয়ের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করা উচিত। প্রয়োজনে বিজ্ঞাপন, লিফলেট বিতরণ বা সোশ্যাল মিডিয়ায় উদ্যোগের মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। যেহেতু একটি জাতি তার সব নাগরিক নিয়ে গঠিত। তাই আমাদের প্রতিটি অনন্য উদ্যোগ দেশের সংকট নিরসনে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। এই কারণে, আমরা কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজে শক্তি ব্যবহার করি সে সম্পর্কে সচেতন হওয়া অত্যাবশ্যক।

উপরন্তু, বিদ্যুৎ পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজতে বিকল্প শক্তির উৎস অনুসন্ধান করার বিকল্প নেই। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, খামার ও গার্হস্থ্য বায়ুশক্তি, ভূতাপীয় শক্তি এবং সমুদ্রের তাপশক্তি থেকেও আমরা বিদ্যুৎ পেতে পারি। এসব বিকল্প উৎসের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিদ্যুৎ অপচয় রোধের পাশাপাশি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয় প্রজন্মের জন্য বিদু্যত্সংকট দূর করা সম্ভব। সামগ্রিকভাবে আমাদের জ্বালানিসংকট মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : নারী ও মানবাধিকারকর্মী



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews