মনে বড় ব্যথা ছিল আল্লাহর হাবীব রসুল (সা.)-এর একজন নগণ্য উম্মত হয়েও তাঁকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। অন্তত নবীজীর রেখে যাওয়া স্মৃতিবিজড়িত মক্কা-মদিনার মাটিতে যদি একটু যেতে পারতাম, দেখতে পেতাম পবিত্র কাবা শরিফ, হজরত ইব্রাহিম ও হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর স্মৃতিময় আল্লাহ প্রদত্ত দৃশ্যগুলো, মিনা, মুজদালিফা এবং আরাফার ময়দানে অবস্থানের সুযোগ পেতাম, পবিত্র রওজা মোবারকে নবীজীর কাছে সালাম পেশ করতে পারতাম। জেয়ারত করতে পারতাম জান্নাতুল বাকি ও জান্নাতুল মুয়াল্লায় শায়িত জান্নাতবাসীদের কবর। এ ধরনের হাজারো আকাঙ্ক্ষা স্মৃতিপটে ভেসে উঠত। মহান রাব্বুল আলামিন ২০১১ সালে সেই আশা পূর্ণ করলেন। দেশ থেকে পবিত্র হজের উদ্দেশে রওনা হলাম। পৌঁছলাম পবিত্র ভূমি মক্কায়। পবিত্র কাবা শরিফ দেখামাত্র আবেগে দুই চোখ অশ্রুতে ভরে এলো। আল্লাহর ঘর কাবার দিকে একপলকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম আর মনে মনে তার শুকরিয়া আদায় করলাম। আগ্রহভরে তাওয়াফ করলাম। জমজমের পানি পান করে প্রাণ তৃপ্ত করলাম। এভাবে তাওয়াফ, হেরেম শরিফে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে দিনগুলো অতিবাহিত করতে লাগলাম। অধীর আগ্রহে জিলহজের ৮ তারিখের অপেক্ষা করতে লাগলাম। কারণ ওই দিন থেকেই হজের মূল কাজ শুরু হয়। দেখতে দেখতে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন চলে এলো। ৭ জিলহজ দিবাগত রাতে আমাদের গ্রুপ লিডার মাওলানা মতিউর রহমান ঘোষণা দিলেন সবাই তৈরি হয়ে যান, এখনই মিনার উদ্দেশে রওনা দিতে হবে। বাস প্রস্তুত। ওই বছর আমাদের হজের কাফেলায় ছিলেন বিদগ্ধ মুহাদ্দিস, গবেষক, বিশিষ্ট লেখক মাওলানা হেমায়েত উদ্দিন, আমার ওস্তাদ, বর্তমানে বেয়াই মালিবাগ মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস ও শাইখুল হাদিস মাওলানা আবু ছাবের আবদুল্লাহ, বারিধারা মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপাল আমার মুরবি্ব ওস্তাদ মাওলানা নাজমুল হাসান, শিক্ষা সচিব ও সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা মকবুল হোসাইন, সিনিয়র মুহাদ্দিস ও বিশিষ্ট আরবি ব্যাকরণবিদ মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ। মাওলানা হেমায়েত উদ্দিন বললেন, চল আমরা হেঁটে হেঁটে হজের বিধানগুলো পালন করি। তার প্রস্তাবে আমরা পাঁচজন সাথী তৈরি হয়ে গেলাম। তখন মনে পড়ে গেল রসুল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামদের আমলের কথা। তাঁরা দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে হজের বিধানাবলি সুচারুরূপে পালন করতেন। তাই একটুও চিন্তা করলাম না যে, মক্কা থেকে মিনার দূরত্ব কত বা এত পথ হাঁটতে পারব কিনা। ৮ জিলহজ ভোরে মিনার উদ্দেশে আমরা পাঁচ সদস্য পায়ে হেঁটে রওনা হয়ে গেলাম। পথিমধ্যে অভিজ্ঞতায় ভরপুর মাওলানা হেমায়েত উদ্দিন মক্কার বিভিন্ন স্থান ও বিভিন্ন মসজিদ দেখালেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটির ইতিহাসও বলতে ভুললেন না। আল্লাহর মেহেরবানীতে জোহরের আগেই মিনায় পৌঁছে গেলাম। রাতে মিনা থেকে ঐতিহাসিক আরাফার ময়দানে অবস্থান করার জন্য রওনা হয়ে গেলাম। ৯ জিলহজ সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত আরাফার ময়দানে অবস্থান করতেই হবে, যা হজের রুকনের মধ্যে অন্যতম। হজের রুকন মোট তিনটি। ১. নিয়ত করে এহরাম বাঁধা। ২. আরাফার ময়দানে অবস্থান করা। ৩. তাওয়াফে জেয়ারত করা। আরাফার ময়দানে সারা দিন অবস্থান করার পর সূর্য ডুবার সঙ্গে সঙ্গে পায়ে হেঁটে রওনা হয়ে গেলাম মুজদালিফায় অবস্থানের উদ্দেশে। পথ কতটুকু বা পথের দূরত্ব কত? কিছুই চিন্তা করলাম না। হাঁটতে হাঁটতে রাত ১২টায় আল্লাহর মেহেরবানীতে মুজদালিফায় পৌঁছলাম। পথে পথে মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। আশ্চর্যের বিষয় হলো মানুষের এত ভিড় সত্ত্বেও নেই কোনো হট্টগোল। না আছে কোনো ধরনের বাকবিতণ্ডা। সবার মুখে একসঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে, 'লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাশারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা, ওয়ান নে'মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লাশারিকা লাকা লাব্বাইক।' কয়েক ঘণ্টা হাঁটার পর আমি বললাম, হুজুর আর পা চলে না। আর কত পথ অতিক্রম করতে হবে? তিনি স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন, আর একটু হাঁটো। একটু পরেই মুজদালিফার সীমানা দেখতে পাবে। সত্যিই কিছুদূর হাঁটার পর দেখতে পেলাম আরবিতে লেখা 'বেদায়াতুল মুজদালিফা।' (মুজদালিফার সীমানা শুরু) সেখানে দেখলাম লাখ লাখ মানুষের সমাগম। বহু মানুষ তাঁবু টানিয়ে, কেউবা পাহাড়ের ওপর উঠে রাত যাপনের ব্যবস্থা করেছেন। মানুষের ভিড় ঠেলে কোনো রকম মসজিদে মাশআরে হেরেমের কাছে পৌঁছলাম এবং ওই মসজিদের পাশেই এক জায়গায় রাত যাপনের সিদ্ধান্ত নিলাম। মাওলানা হেমায়েত উদ্দিন হুজুর বললেন, কিছু বিছিয়ে এখানেই আমরা অবস্থান করব। সাথীদের মধ্যে আমার কাছেই একটি বিছানার চাদর ছিল, তা বিছিয়ে কোনো রকমে চারজনের বসার ব্যবস্থা হলো। তখন রাত ১২টা ৩০ মিনিট। হুজুর বললেন, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর নামাজগুলো আদায় করে নেব। কারণ আমরা সবাই ছিলাম প্রচণ্ড ক্লান্ত। পেটে ছিল প্রচুর ক্ষুধা। পানির তৃষ্ণায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার উপক্রম। আমাদের কাছে থাকা পানি বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। ওইদিকে আরাফার ময়দানে শুধু তরলজাতীয় কিছু খাবার গ্রহণ করা হয়েছে। ভারী খাবারের কোনো সুযোগই ছিল না। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত সাথীরা বিছানার ওপর বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এতকিছুর পরও তখন কিন্তু আমাদের মধ্যে আল্লাহপাকের দেওয়া এক ধরনের প্রশান্তি বিরাজ করছিল। আলোচনা চলছে কী খাওয়া যায়। হুজুর বললেন, এখানে তো তেমন কিছু পাওয়া যায় না। চা-এর দোকান আছে। সেখানে চা-বিস্কুট ও পাউরুটি জাতীয় কিছু খাবার পাওয়া যায়। সেখান থেকে কিছু খেয়ে নিতে হবে। আমি মনে মনে ভাবলাম পেটে যে ক্ষুধার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে এই হালকা খাবারে কিছুই হবে না। তবে এমন ভাবার কারণও আছে। আমাদের চার সদস্যের মধ্যে একমাত্র আমিই নতুন। বাকি তিনজনই কয়েকবার হজ করেছেন। তারা এ ধরনের পরিস্থিতি সামলানোয় অভ্যস্ত। বিছানায় বসে আমি তাকিয়ে তাকিয়ে আল্লাহর কুদরতের বিভিন্ন নিদর্শন দেখছিলাম। হঠাৎ উন্নত মানের খাবার বিরানির ঘ্রাণ নাকে লাগল। মনটা কেমন যেন আনন্দিত হয়ে উঠল। তাকিয়ে দেখি বিরানির চারটি প্যাকেট ও চারটি পানির বোতল কে যেন আমাদের সামনে রেখে চলে গেল। আমরা কিছু বোঝার আগেই লোকটি উধাও। কে দিল এই খাবার। কেনই বা দিল। কিছুই বুঝতে পারলাম না। তখন হুজুর বললেন, নাও খাও। এই হলো আল্লাহর সাহায্য। বান্দা যখন আল্লাহর ওপর পূর্ণরূপে ভরসা করে তখন আল্লাহর পূর্ণ সাহায্য আসে। আমরা প্রাণভরে সেই খাবার গ্রহণ করলাম আর আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলাম। খাবারের পর্ব শেষ হলো। হঠাৎ দেখি, এক ব্যক্তি বালুর স্তূপের ভিতর পুরো হাত ঢুকিয়ে দিল। সেখান থেকে বালু বের করে পুরো শরীরে মাসেহ করতে লাগল। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কী ব্যাপার আপনি এই কী করছেন। তিনি বললেন, তাইয়াম্মুম করছি। আমরা আফসোস করে বললাম, ধর্মীয় জ্ঞান না থাকার কারণে এই বেচারা বালু দিয়ে পুরো শরীর একাকার করে ফেলছে। তাইয়াম্মুম কখন করতে হয়। কেন করতে হয়। তাইয়াম্মুমের ফরজ কয়টি। কিছুই তার জানা নেই। তাকে বলা হলো ভাই আপনার কাছে তো পানি আছে, আপনি অজু করে নিন। তবে ভবিষ্যতে কখনো যদি তাইয়াম্মুম করতে হয় তাহলে প্রথমে নিয়ত করবেন। এরপর মাটির ওপর একবার হাত মেরে কনুই পর্যন্ত মাসেহ করবেন। এরপর আবার মাটির ওপর হাত মেরে চেহারা মাসেহ করবেন। এই তিনটি হলো তাইয়াম্মুমের ফরজ। আবার দেখলাম। কিছু লোক বড় বড় ইটের টুকরা ব্যাগে ভরছে। হুজুর বললেন, জানো এরা কেন ইটের টুকরা ব্যাগে ভরছে। আমি বললাম, কেন? তিনি বললেন, এরা সকালে বড় শয়তানকে পাথর মারবে। বড় শয়তান যেহেতু বড়, তাই তাকে বড় পাথর মারতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল এক মুরবি্বর কথা। তিনি বলেছিলেন, এক ব্যক্তি জমারাতে গিয়ে সজোরে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করেছেন। একপর্যায়ে রাগে নিজের পায়ের জুতা খুলে শয়তানকে নিক্ষেপ করে বললেন, ভাই ইয়ে আখের লে-লো (শয়তান তুমি এই শেষ জুতাটি নিয়ে নাও)। অথচ হাদিসে এই কঙ্কর সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, এই পাথরটি ছোলা বুট সমপরিমাণ হবে। এর থেকে বেশি বড়ও নয়, আবার ছোটও নয়। মানুষের এসব কাণ্ড দেখে আমার মনে হলো সাধারণ ব্যক্তিদের অবশ্যই অভিজ্ঞ কোনো লোকের সঙ্গে হজ করতে হবে, যারা হজের বিধিবিধানগুলো সবিস্তারে জানেন ও বোঝেন। এ বছর যারা হজে গেছেন আল্লাহপাক সবাইকে সঠিকভাবে হজ করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব বারিধারা, ঢাকা।