ছবির ক্যাপশান,
গো-রক্ষকরা নিহত যুবকের বস্তিতে জিজ্ঞাসাবাদ চালান ও পরে তাকে তুলে নিয়ে যান বলে অভিযোগ।
Author,
সৎ সিং
Role,
বিবিসি পাঞ্জাবির জন্য
২৬ মিনিট আগে
দিল্লি থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে হরিয়ানার চরখি দাদরির বাধরা এলাকায় এক মুসলিম যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে গো-রক্ষক দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে।
নিহত ব্যক্তির নাম সাবির মালিক। তিনি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বাসিন্দা। ওই ব্যক্তি পরিবারের সঙ্গে চরখি দাদরির একটি বস্তিতে থাকতেন। পেশায় পরিচ্ছন্নতা কর্মী।
পুলিশ জানিয়েছে ঘটনাটি ২৭শে অগাস্টের। গো-রক্ষক দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা একটি পাত্রে এক টুকরো মাংস দেখতে পান। তাদের সন্দেহ ছিল ওই টুকরোটি গো-মাংস।
এর জেরে ওই যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ। এই ঘটনায় গত ২৯শে অগাস্ট পুলিশ সাতজনকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশ জানিয়েছে ধৃতদের মধ্যে দুজন নাবালক রয়েছে।
গত ৩১শে অগাস্ট এক ব্যক্তিকে লাঠি দিয়ে পেটানোর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
সেখানে যে যুবককে মারধর করা হচ্ছিল তিনি ২৪ বছরের সাবির। তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে দেখা যায় একদল ব্যক্তিকে।
ওই ঘটনায় যুবকের মৃত্যুর ঘটনা প্রকাশ্যে এলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর পক্ষ থেকে সাবির মালিকের পরিবারের একজন সদস্যকে চাকরি এবং তাদের আর্থিক সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী নায়াব সিং সাইনি এই ঘটনাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। যদিও তার মতে একে ‘গণপিটুনির ঘটনা’ বলা ঠিক নয়।
ছবির ক্যাপশান,
মহারাষ্ট্রে সত্তোর্ধ ব্যক্তিকে ট্রেনে গরুর মাংস নিয়ে যাওয়ার কারণে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন হরিয়ানার নুহ্ শহরের কংগ্রেস বিধায়ক আফতাব আহমেদ। ওই রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন তিনি।
আফতাব আহমেদ বলেন, “হরিয়ানায় আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। একজন দরিদ্র পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে টার্গেট করা হয়েছে, যা উদ্বেগজনক। তিন-চার দিন আগে এই ঘটনা ঘটেছে, সেটি জানতে এত সময় লাগল কেন?”
উত্তরপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীও এই ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন।
তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, “গরুর মাংস খাচ্ছে এই সন্দেহে চরখি দাদরিতে এক দরিদ্র যুবককে নৃশংসভাবে পিটিয়ে পিটিয়ে মারার ঘটনাটি মানবতার জন্য লজ্জাজনক এবং এটি আইনের শাসনকে উন্মোচিত করে।”
প্রসঙ্গত, মহারাষ্ট্রের নাসিক থেকেও সম্প্রতি একই ধরনের একটি অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে।
ইগতপুরীর কাছে একটি এক্সপ্রেস ট্রেনে গরুর মাংস সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন সন্দেহে সত্তোর্ধ এক মুসলিম ব্যক্তিকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে কয়েকজন যাত্রীর বিরুদ্ধে। ঘটনাটি ২৮শে অগাস্টের।
এই দুই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর তীব্র নিন্দায় সরব হয়েছেনা অনেকেই।
লোকসভায় বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীও চরখি দাদরিতে যুবককে হত্যা এবং নাসিকে গো-মাংস নিয়ে যাচ্ছেন এই সন্দেহে এক বৃদ্ধকে মারধরের ঘটনা নিয়ে মন্তব্য করেছেন।
এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে রাহুল গান্ধী লিখেছেন- “সাধারণ মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ঘৃণ্য উপাদানগুলি আইনের শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রকাশ্যে সহিংসতা ছড়াচ্ছে। সংখ্যালঘুরা, বিশেষত মুসলমানদের উপর হামলা অব্যাহত রয়েছে এবং রাষ্ট্র নীরব দর্শকের মতো সব দেখছে।”
গো-মাংসকে কেন্দ্র করে মারধর ও হত্যার যে ঘটনা দুটি প্রকাশ্যে এসেছে সেখানে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি লেখেন, “এ ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা উচিত।”
ছবির ক্যাপশান,
নিহত যুবক হরিয়ানাতে চরখি দাদরি বস্তিতে থাকতেন।
এখনও পর্যন্ত যে তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে সেখান থেকে জানা গিয়েছে, চখরি দাদরি অঞ্চলের বাধরা বাসস্ট্যান্ডের সামনে এক মুসলিম বস্তি রয়েছে, যেখানকার বাসিন্দারা গো-মাংস খাচ্ছেন বলে গো-রক্ষা দলের ব্যক্তিদের সন্দেহ হয়।
গত ২৭শে অগাস্ট ‘গো-রক্ষা’ দলের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিরা ওই বস্তির লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।
অভিযোগ রয়েছে, সে সময় তারা একটি পাত্রে এক টুকরো মাংস দেখতে পান, যা গো-মাংস বলে সন্দেহ করেন তারা।
এ সময় তারা ওই বস্তিতে বসবাসকারী শবরুদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, যিনি নিহত সাবিরের আত্মীয় হন। জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনার ভিডিও করা হয়।
এফআইআর অনুযায়ী, পাত্রে থাকা মাংস গরুর কিনা জানতে চাইলে তিনি ওই মাংস মহিষের এ কথা জানিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন।
কিন্তু গো-রক্ষক দলের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিরা তাকে আবার ধরে আনে এবং ক্যামেরার সামনে স্বীকার করায় যে পাত্রে রাখা টুকরোটি গো-মাংস।
এরপর গো-রক্ষকরা বাধরাপুলিশকেও এই বিষয়ে জানায়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মাংসের টুকরো সমেত কয়েকজনকে থানায় নিয়ে যায়।
ছবির ক্যাপশান,
সাবির মালিক যে এলাকায় থাকতেন সেখানকার বাসিন্দারা এখনও আতঙ্কে রয়েছেন।
এদিকে, সাবির মালিকের হত্যার ঘটনায় যিনি পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন তিনি নিহত যুবকের শ্যালক সাজাউদ্দিন সর্দার।
অভিযোগকারী জানিয়েছেন, “২৭শে আগস্ট কিছু লোক এসেছিল। ওরা আমাকে এবং আমার সঙ্গে যারা আবর্জনা সংগ্রহ করছিল তাদের বলতে শুরু করে যে, তোমরা এখনও মঙ্গলবারে মাংস খাও বা হতে পারে এটাই (পাত্রে থাকা মাংসের টুকরোকে ইঙ্গিত করে) গো-মাংস।”
“এরপর আমাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েকজন আবার আমার ভগ্নিপতি সাবির মালিককে বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে যায়।”
ঘটনার দিনের বিবরণ দিতে গিয়ে সাজাউদ্দিন সর্দার যোগ করেছেন, “ওকে কিছু আবর্জনা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।”
“ওই কথা বলেই বাসস্ট্যান্ডে জামাইবাবুকে (সাবির মালিক) ডেকে নিয়ে যাওয়ার পর, আসিরুদ্দিন নাম আরেকজনকেও ডেকে আনা হয়। সেখানে ওদের দুইজনকে চার-পাঁচজন ছেলে মিলে মারধর করে। আমার ভগ্নিপতি ও আসিরুদ্দিনকে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। ভাইরাল ভিডিওটি আমিও দেখেছি।”
আসিরুদ্দিন জানান, গোরক্ষকরা পুলিশের সঙ্গে থানায় গিয়েছিলেন। তারা বস্তির লোকেদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার জন্য চাপও দেয়।
আসিরউদ্দিনের অভিযোগ, তাকে এবং সাবির মালিককে বাধরা বাসস্ট্যান্ডের কাছে ডেকে নিয়ে লাঠি দিয়ে মারধরহয়।
তিনি জানিয়েছেন, স্থানীয়রা হস্তক্ষেপ করায় গো-রক্ষক দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা সাবির মালিককে মোটর সাইকেলে তুলে নিয়ে যায়।
এফআইআর অনুযায়ী, ২৭শে আগস্ট রাতে ভান্ডওয়া গ্রামের কাছে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির দেহ পাওয়া যায়। পরে সেটি সাবির মালিকের দেহ বলে শনাক্ত করা হয়।
মৃতের শ্যালক সাজাউদ্দিন সর্দারের অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২৮শে আগস্ট বাধরা থানার পুলিশ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
তাদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু করা হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে দুইজন নাবালকও রয়েছে।
গো-মাংস নিয়ে কথা বলতে রাজি নন মৃত যুবকের বাড়ির কেউই। তার পরিবারের সদস্যরা ৩০শে অগাস্ট চরখি দাদরি ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে যান।
সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল।
বিবিসি বস্তির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ওই এলাকায় এখনও ভয়ের পরিবেশ রয়েছে।
বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এই ঘটনার পরে তারা আতঙ্কে রয়েছেন এবং ওই এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার পরিকল্পনাও করছেন।
চরখি দাদরির বাধরা জেলার ডিএসপি ভূষণ জানিয়েছেন, ঘটনার ঠিক পরদিনই পুলিশ একটি মামলা দায়ের করে এই ঘটনায় অভিযুক্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
অভিযুক্ত দুই নাবালক ছাড়া সকলেই পুলিশ রিমান্ডে রয়েছেন। বাকিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
হরিয়ানা পুলিশের কর্মকর্তা ধীরজ কুমার জানিয়েছেন, এলাকায় উত্তেজনা এড়াতে ফ্ল্যাগ মার্চ করছে পুলিশ। বর্তমানে সেখানে শান্তি বজায় রয়েছে।
তিনি জানিয়েছেন, এই ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য কোনও অভিযুক্তের নাম উঠে আসলে তার বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।