বিশ্বের কথিত মোড়ল দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ৬০তম চতুর্থ বার্ষিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৫ নভেম্বর। দেশটির ভোটাররা চার বছর মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে গোটা বিশে^র রাজনৈতিক পরিস্থিতির রসায়ন নিয়ে নানারকম আলোচনা-সমালোচনা চলছে। প্রধানত দুটি রাজনৈতিক দল ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।

তার রানিং মেট ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসই ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত হয়েছেন। অন্যদিকে, রিপাবলিকান সদস্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে এখন নির্বাচনী প্রচার তুঙ্গে। কে হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের আগামী চার বছরের অধিকর্তা?Ñএ প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে বিশ্বে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রেওয়াজ অনুসারে টেলিভিশন বিতর্ক হয়েছে দুই প্রার্থীর মধ্যে। উল্লেখ্য, প্রথমদিকে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী হিসেবে জো বাইডেন ট্রাম্পের সঙ্গে বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সে বিতর্কে ট্রাম্পের সঙ্গে বাইডেনের অসহায়ত্ব বিশ^বাসী প্রত্যক্ষ করেছে।

৮১ বছর বয়সী জো বাইডেন আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে কীভাবে নেতৃত্ব দেবেন দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য, সে সম্পর্কে স্বচ্ছ কোনো দর্শন উপস্থাপন করতে পারেননি। গত জুনে অনুষ্ঠিত ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বাইডেনের বিতর্ক ছিল অনেকটাই একপক্ষীয়। সাবেক রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান রোডনি ডেবিস মন্তব্য করেছিলেন এ রকমÑ ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিষ্কার জয়’। আমেরিকাজুড়ে ডেমোক্র্যাটদের জন্য দুঃখজনক বিতর্কের ধরনটি ট্রাম্পকে জয়লাভে সহায়তা করেছে। বাইডেন অবশ্য সে বিতর্কে খারাপ পারফর্ম্যান্সের জন্য অনেক যুক্তি খাড়া করেছিলেন।

যা হোক, সেটি পুরনো কথা। মূলত বাইডেনের পারফর্ম্যান্স খারাপ হওয়ার কারণেই ডেমোক্র্যাটরা তাকে মনোনয়ন বঞ্চিত করেন বলে ধারণা। পরবর্তীতে ৫৯ বছর বয়সী কমলা হ্যারিসকে প্রার্থী করেন ৭৮ বছর বয়সী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপক্ষে। গত ১১ সেপ্টেম্বর কমলা হ্যারিস ও ট্রাম্পের ৯০ মিনিট বিতর্ক হয়। বিশে^র কোটি কোটি মানুষ সে বিতর্ক প্রত্যক্ষ করেন। বিতর্কে কমলা হ্যারিস ছিলেন খুবই প্রাণবন্ত ও স্মার্ট।

সে হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেকটা ম্রিয়মাণ। বিতর্কে কমলার বিজয় হয়েছে মনে করা হলেও জনমত জরিপের ব্যবধান খুবই সামান্য। কোনো কোনো রাজ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প এগিয়ে, আবার কোনো কোনো জায়গায় কমলা হ্যারিসকে অগ্রগামী দেখানো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হন, সেটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আগামী ৫ নভেম্বর পর্যন্ত।
বিশ^বাস্তবতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। গোটা পৃথিবীর রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির ওপর। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান যে প্রার্থীই জয়ী হোক না কেন, পররাষ্ট্রনীতির তেমন কোনো হেরফের হয় না। কিন্তু এখানে একটা ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে। রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক নীতির সঙ্গে প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত দর্শনের একটা সাযুজ্য ঘটে। ২০১৪ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।

গোটা বিশে^র রাজনীতির রসায়ন অনেকটাই বদলে গিয়েছিল। একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, রাজনীতিতে কোনো রাষ্ট্রনায়ক যদি বাসনা ও ইন্দ্রিয় ভোগের পেছনে ছোটে, তার দ্বারা রাষ্ট্র ও জনগণ তেমন উপকৃত হন না। যিনি রাষ্ট্র ও মানুষের ভোগ বাসনায় অনুপ্রবেশ করেন, তিনি কখনো অন্তরে বিক্ষুব্ধ হন না। স্থির ও শান্ত অবস্থায় থাকেন। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্র সমান্তরালভাবে সক্রিয় থাকে। এ রকম নেতৃত্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যদি এ রকম মনমানসিকতার হন, তবে বিশে^ দ্রুত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে বাধ্য। কেননা, দেশটির রাজনীতিই সারাবিশ^কে প্রভাবিত করে।

প্রত্যেক মানুষেরই রয়েছে তার নিজ নিজ ধর্ম বা জীবনযাপন, কর্মসম্পাদন ও মানবিক সম্পর্ক স্থাপনের পদ্ধতি। মানসিক বিন্যাস অনুযায়ী মানুষ বিশেষ মানসিক প্রবণতা ও কর্মসামর্থ্যরে অধিকারী হয়ে থাকে। রাষ্ট্রীয় নীতি যেভাবেই প্রণীত হোক না কেন, ব্যক্তি চিন্তার প্রভাবটাও এর মধ্যে প্রতিফলিত হয়। কথায় আছে, রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট প্রজা কষ্ট পায়, নারীর দোষে সংসার নষ্ট শান্তি চলে যায়। সুতরাং রাজা যদি সঠিক না থাকে, তবে রাজ্যটাও সঠিক পথে চলবে না। রাজ্য সঠিক পথে না চললে প্রজার দুঃখের শেষ থাকবে না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যদি সৎ ও শান্তিকামী না হন, তবে বিশ^ও অশান্ত হয়ে উঠবে। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবে প্রভাবিত হয় সারাবিশ^ই। তাই সে দেশের প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিচিন্তার বিষয়টাকে গুরুত্ব দিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিও বিশ^ অর্থনীতিকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। দেশটির ডলারের মান হ্রাস-বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে বিশ^ মুদ্রা বাজার। বর্তমানে গোটা পৃথিবী একটা সংকটকাল অতিক্রম করছে। দেশে দেশে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে কোনো কোনো দেশে অসাংবিধানিকভাবে সরকারের পরিবর্তন ঘটেছে।

ভূরাজনীতির প্রভাব বলয় সৃষ্টির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে শক্তিধর দেশগুলো মানবতাকে উপেক্ষা করে চলছে। প্রতিষ্ঠা করছে নিজস্ব তাঁবেদারি সরকার। তৃতীয় দেশগুলোর জনগণের সস্তা আবেগকে পুঁজি করে আসল সত্য লুকিয়ে বিভ্রান্ত করছে সাধারণ মানুষকে। বিভিন্ন দেশ এজন্য দায়ী দেশগুলোর বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে পারছে না। এই অবস্থার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

এই নির্বাচনে একজন সৎ যোগ্য ও প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব যদি মার্কিন মুল্লুকে ক্ষমতাসীন হয়, তবে পৃথিবীর জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে বলে বিশিষ্টজনের ধারণা। যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিষয়ে খুবই সোচ্চার। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদ্বন্দ্বী ২ জন প্রার্থীরই মানসিক স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। সে স্বাতন্ত্র্য গড়ে উঠেছে জীবনের বিশেষ বিশেষ গতি, প্রবণতা-প্রতিক্রিয়া, পছন্দ-অপছন্দকে ভিত্তি করে। আমাদের দেখতে হবে কে কোন্ বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়।

গাজা যুদ্ধের পরিণতি
মধ্যপ্রাচ্যে গাজা-ইসরাইল যুদ্ধ আরও ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনবে। যদিও এ যুদ্ধ নতুন কোনো ঘটনা নয়। ১৯৪৮ সাল থেকেই যুদ্ধের সূত্রপাত। ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইসরাইল ও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ফিলিস্তিন। এ বিরোধ সৃষ্টি হয় ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ডেভিড বেন গুরিয়ন কর্তৃক ইসরাইলের স্বাধীনতা ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে। মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তৎকালীন বিশ^ পরাশক্তিধর ফ্রান্স, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে।

এতে করে আরব বিশে^র ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে। মুসলিম জাহানের বুক চিরে একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র গঠন ছিল চক্রান্তেরই অংশ। যেজন্য সবসময় এ অঞ্চলে যুদ্ধ লেগেই থাকে। মূলত চিরস্থায়ী যুদ্ধযজ্ঞের ব্যবস্থার লক্ষ্যে এমন একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ফিলিস্তিনির একটি উপত্যকা হচ্ছে গাজা। মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে গাজা হচ্ছে পবিত্র পুণ্যভূমি। সে ইতিহাস আলাদা। সে কথায় যাচ্ছি না। গাজা-ইসরাইল যুদ্ধ একটি ধারাবাহিক কর্মযজ্ঞ। এ যুদ্ধ কখনো থামে, কখনো লম্বা বিরতিতে আবার শুরু হয়। এভাবে চলছে দীর্ঘকাল ধরে। এ যুদ্ধে মানবতা বিপন্ন।

ইসরাইলি হামলায় প্রতিদিন হাজার হাজার নারী শিশুসহ সাধারণ মুসলমানদের প্রাণহানি ঘটছে। কেউ কেউ উদ্বাস্তু জীবনের লক্ষ্যে পাশর্^বর্তী লেবাননে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, সেই লেবাননেও ইসরাইল বর্বরোচিত হামলা করেছে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী একে গাজা যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে লেবাননে। দক্ষিণ লেবাননের বাসিন্দারা বাঁচার জন্য পালিয়ে যাচ্ছেন।

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে এ পর্যন্ত প্রায় ৪২ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এ হিসাবটি ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এর মধ্যেই আবার লেবাননে আক্রমণ। কী ভয়াবহ অবস্থা। গত কয়েকদিনে ইসরাইল লেবাননে বিমান হামলা চালিয়েছে। স্থল হামলারও প্রস্তুতি নিচ্ছে। লেবাননভিত্তিক শিয়াপন্থি রাজনৈতিক দল হিজবুল্লাহও পাল্টা আঘাত হানছে। হত্যা করা হয়েছে হামাসের প্রধান নেতা এবং হিজবুল্লাহর প্রধানকে। এমন পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে উঠছে অগ্নিগর্ভ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায় হিজবুল্লাহ ও হামাস হচ্ছে সন্ত্রাসী সংগঠন। ফলে, যুক্তরাষ্ট্র তার দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে ইসরাইলকেই সমর্থন দিয়ে আসছে। মুসলিম বিশে^র ইরানসহ অনেক দেশই যথাযথ হিজবুল্লাহকে সমর্থন করে রাজনৈতিক সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক সাহায্য করে থাকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ যুদ্ধের শেষ কোথায়? মানব সভ্যতায় মানবসত্তার প্রয়োজন ও স্বাধীনতা দুটোই রয়েছে। মানব জাতি কিছুটা প্রাকৃতিক নির্দেশনায় চালিত হয় আর কিছুটা স্বাধীনভাবে।

সামান্য স্বাধীনতা পেলেই মানুষ চঞ্চল হয়ে ওঠে। কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ কীভাবে ভোগ করতে হয়, সেটা জানা নেই মানবগোষ্ঠীর। সেজন্যই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলছে অবিরাম। যুদ্ধ নয়, শান্তি ও প্রত্যাশার জায়গা তৈরিতে প্রয়োজন অন্তর্নিহিত শক্তিসম্পন্ন একজন বিশ^নেতার।

লেখক : আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক

[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews