ফরিদপুরে কখন কীভাবে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়, এই বিষয়ে ইনকিলাবের সাথে কথা হয় আন্দোলনের শুরুতে থাকা ফরিদপুর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম কাতারের নেতা মো. আবরার নাদিম ইতুর সাথে। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রথম কাতারের নেতাদের নির্দেশে ৯ জুলাই রাতে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের মাঠে প্রথম আন্দোলনের মিটিং হয়।

রাত পোহালেই ১০ জুলাই, রাতেই সিদ্ধান্ত হয় সকালে রাজ পথে নামার। মিটিংয়ে ছিলেন, আরাফাত শাহ, জনি বিশ্বাস, আবরার নাদিম ইতু। ১৪ জুলাই থেকে নতুন আগমন ঘটে মো. সোহেল রানার। এখনও সক্রিয় আছেন। তিনি এখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফরিদপুর জেলার সদস্য সচিব।

১৫ জুলাই ও ১৬ জুলাই নারী নেত্রী হিসেবে দলে যোগদেন কাশফিয়া, মারুফা, তানিয়া ও জেবা। এরা সকলেই রাজেন্দ্র কলেজের নিয়মিত অনার্স বিভিন্ন বর্ষের ছাত্র/ছাত্রী। এরাই ফরিদপুরের রাজ পথের সীমিত আন্দোলনকে গণআন্দোলনে রূপ দেন। শুরু হয় জনতার জনস্রোতের অগ্নিরূপ ধারণ। সকাল-দুপুর-বিকেল গড়িয়ে আসতে না আসতেই নতুন নতুন মুখ; সবাই ছাত্র, শ্রমিক, শিক্ষক। সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলনকে নেপথ্যে থেকে এগিয়ে নিয়ে যান। ১৬ জুলাই আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে, ফরিদপুর গালর্স স্কুলের সামনে থেকে পুলিশের হাতে আটক হয় ছাত্র নেতা আরাফাত, জনি, সাইফুল। এই আন্দোলনে ফরিদপুর জেলা ছাত্রদলের নেতা মো. তামজিদুল কায়েস, জনি, সাইফুলসহ ৯ উপজেলায় একই দিনে ৬০ জন আটক হয় পুলিশের হাতে।

জনতা, অভিভাবক শিক্ষক, কৃষক, কৃষাণী, শ্রমিক, দিন মজুর, শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ-আবাল-বনিতা সকলেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে রাস্তায় নামে। আমরা যদি একেবারে খোলশাভাবে বলি, জুলাই আন্দোলনের মূল প্রেক্ষাপট ছিলো ‘কোটা বিরোধী’ আন্দোলন। এই আন্দোলন শুরুতে সভা-সমাবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের পরোক্ষভাবে ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ হিসেবে অভিহিত করেন; প্রথমত, শেখ হাসিনার মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’ এবং ‘চেয়েছিলাম/চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার’ স্লোগান দেয়।

দ্বিতীয়ত, এর পরদিন ১৫ জুলাই, আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা, মন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নষ্ট করার অভিযোগ আনেন। তৃতীয়ত, ১৫ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতৃত্বে শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীদের উপর রড, লাঠি, হকি স্টিক, রামদা, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করা হয় দেশব্যাপী। ফরিদপুরেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ফরিদপুর জনতার মোড়, রাজেন্দ্র কলেজ এলাকা, কোর্টচত্বর, পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় দফায় দফায় ছাত্র-জনতার সাথে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও লাটিপেটা এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। ১৫ জুলাই ছাত্রলীগের প্রথম হামলায় আহত হয় ১০/১২ জন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মী ও দুইজন মেডিকেল ছাত্রী।

চতুর্থত, ১৬ জুলাই একই সাথে পুলিশও লাঠি, রাবার বুলেট দিয়ে হামলা করে আন্দোলনকারীদের উপর। প্রতিবাদে আন্দোলনকারীও তাদের দিকে ইটের টুকরা ছুড়লে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এসব হামলায় ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। এইদিনে সরকার দলীয় লোক, পুলিশের টিয়ার সেল ও ইটপাটকেলে আহত হয় ১৬ জন ছাত্র নেতা। তার মধ্যে ইতু, নিশাত ও সেহেলও ছিল।

১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হলে আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো পুরো দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়লে গোটা ফরিদপুরেও ছড়িয়ে পড়ে।

১৭ জুলাই ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর নার্সিং ইনস্টিটিউটের ছাত্র-ছাত্রীসহ ৬/৭টি নার্সিং ইনস্টিটিউটের ৫-৬ শত ছাত্র-ছাত্রী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে ফরিদপুর ভাঙ্গা রাস্তার মোড় হতে মুন্সিবাজার বাইপাস সড়ক পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার সড়ক সম্পূর্ণভাবে তাদের মিছিলের নগরীতে পরিণত করে। ঐ দিন থেকেই আন্দোলনকারীদের সাথে যোগদেয় উল্লেখিত এলাকার ঝিঁ বউয়েরা। প্রায় বাড়ি থেকে বউ, বৃদ্ধ ও নারী শিশুরা যার যা ছিল তাই নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল।

১৯ জুলাই পর্যন্ত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অনান্য সংগঠন, বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ দিয়ে ও ইন্টারনেট বন্ধ করেও আন্দোলন থামাতে কার্যত ব্যর্থ হলে সরকার দেশজুড়ে কারফিউ জারি করে এবং মাঠে সেনাবাহিনী নামায়, ফরিদপুরের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা। এরাও থামাতে পারেনি ফরিদপুরের রাজপথের মিছিল মিটিং।

এইসব ঘটনায় কয়েক হাজার শিক্ষার্থী (প্রায় ২১ হাজার শিক্ষার্থী) ও আন্দোলনকারী আহত হওয়ার পাশাপাশি ৬৭৩ জনের অধিক নিহত হয়। এর মধ্যে ফরিদপুরের ছিল ৭ জন।

পঞ্চমত, পুলিশ সারাদেশে ৫০০টি মামলা করে। ১১,০০০-এর অধিক মানুষকে গ্রেপ্তার করে। ফরিদপুরেও ২৪-২৫ জন শিক্ষার্থী আটক হয়। আটক ওই শিক্ষার্থীরা বেশ কিছুদিন জেল হাজতেও থাকে। আবার আন্দোলনের মুখে তাদের জামিন হয়। কিন্তু মামলা থেকে যায়।

ষষ্ঠত, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে ও সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। ২২ জুলাই এই বিষয়ে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে। তখন ফরিদপুরে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। পাড়ায় মহল্লায় শুরু হয়ে যায় গণ আন্দোলন।

সপ্তমত, প্রজ্ঞাপনের ফলে কোটা সংস্কার হলেও এরই ধারাবাহিকতায় সরকার পতনের এক দফা দাবিতে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় এবং ৫ আগস্টে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ত্যাগের মাধ্যমে আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি পায়।

লেখক: জেলা সংবাদদাতা, ফরিদপুর।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews