ইতিহাসের সময়তরিতে চড়ে চলুন ঘুরে আসি আঠারো শতকে। কোনো এক ঈদের দিন সকালবেলা। মুঘল রাজধানী ঢাকা। ঢাকার নায়েব-নাযিমদের বাসস্থান নিমতলী প্রাসাদ থেকে বেরিয়েছে ঈদের বর্ণাঢ্য মিছিল। সুসজ্জিত হাতিতে চড়ে বসেছেন মহামান্য নায়েব-নাযিম। মিছিলে আছে উট-পালকি। বাজছে বাঁশি, কাড়া-নাকাড়া শিঙা। কে নেই এই মিছিলে! আছেন সাধারণ ঢাকাবাসী, বহিরাগত মুঘল, ইংরেজ সাহেব। আছে ফকির-মিসকিন। বিভিন্ন পথ ঘুরে, চকবাজার, হোসেনি দালান হয়ে মিছিল আবার শেষ হলো মূল জায়গায় এসে। তারপর সাধ্যমতো খানাপিনার ব্যবস্থা। নায়েব-নাযিমের বাড়িতে আজ সবার আমন্ত্রণ। ঢাকার আকাশে-বাতাসে সম্প্রীতির সুর।

সবার কণ্ঠে গান:
‘আও আও মিলকে চালে হিন্দু-মুসলমান
দুনো হাম হায় পাড়োশি, ঝগড়া কাহেকা
আও আও মিলকে চালে হিন্দু-মুসলমান।’
২.
ঢাকায় ঈদ মিছিল কোনো অলীক কল্পনা নয়। অনেক ঐতিহাসিকই এ রকম ঈদ মিছিলের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে আলম মুসাওয়ার (কারও কারও মতে আলম মুসাব্বির) নামের এক শিল্পী ঢাকায় ঈদ ও মুহাররম মিছিলের ৩৯টি ছবি এঁকেছিলেন। ঢাকায় ঈদ মিছিল নিয়ে আজ পর্যন্ত যত লেখা বেরিয়েছে, সবার সূত্র এই আলম মুসাওয়ার। তাঁর এই ছবিগুলো রাখা আছে ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরে।

ঢাকায় ঈদ মিছিল কবে শুরু হয়েছিল, আর কবে শেষ হয়েছিল, তার প্রকৃত ইতিহাস কোথাও নেই। তবে ইসলাম খান সপ্তদশ শতকের শুরুতে ঢাকায় সুবেদার হিসেবে আসার পর এ অঞ্চলে ইসলামি সংস্কৃতির বিকাশ শুরু হয়। বলা হয়ে থাকে, তারই রেশ ধরে এই ঈদ মিছিল।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকা: স্মৃতি: বিস্মৃতির নগরী’ গ্রন্থে লেখা হয়েছে, ‘খুব সম্ভব ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি ঢাকার নায়েব-নাযিমদের বংশ লুপ্ত হয়ে গেলে, সমাপ্তি ঘটেছিল এ মিছিলের। কারণ, ধনাঢ্যের পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত এ ধরনের মিছিল সংগঠিত করা দুরূহ।’

ঈদ, মুহাররমের মিছিলের পাশাপাশি ছিল জন্মাষ্টমীর মিছিল। এ মিছিলও রূপ পেত অসাম্প্রদায়িকতায়, বইপত্র-ইতিহাসে তেমনই দেখা যায়।

৩.
এবার আমরা ফিরে আসি একবিংশ শতাব্দীতে, আজকের ২০১৭ সালে। এখন আর ঢাকায় ঈদ মিছিল হয় না। ঢাকা এখন অনেকটা শুষ্ক নগরী। যাঁরা এই শহরের মূল বাসিন্দা নন, তাঁরাও যেন আপন করে নিতে পারেন না এই শহরকে। ঈদ এলেই তাঁরা ফিরে যান নিজ গ্রামে। আপনজনের কাছে। এই শহরে তাঁরা থাকেন কেবল কর্মের সূত্র ধরে।

ঢাকাও যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে দুই ঈদের সময়। বিচ্ছেদের বেদনায় কাতর হয় না এতটুকু।

৪.
ঈদ মিছিল নিয়ে আমরা একটা স্বপ্ন দেখতে চাই। চোখ বন্ধ করুন প্রিয় পাঠক। আমরা এখন স্বপ্ন দেখছি।

পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক। এই আন্টাঘর ময়দানেই ব্রিটিশ রাজ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরেছিল শত শত স্বদেশিকে। বৃক্ষশোভিত পার্কের সামনে ঈদ মিছিলের আয়োজন। মিছিলের সামনে আছেন মাননীয় প্রধান দুই নেত্রী। তাঁরা একে অপরের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করছেন। মিছিলের সামনে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়েছেন প্রধান দুই দলের সাধারণ সম্পাদক। তাঁদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন ঢাকার দুই মেয়র। খানিক বাদেই ঈদ মিছিলে যোগ দিলেন মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি। মিছিল যেখানেই যাচ্ছে, প্রচুর তরুণ-তরুণী শামিল হচ্ছেন। নেত্রীদ্বয়কে কাছাকাছি আলাপ করতে দেখে সবাই খুশি। মিছিলে আছে এ দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষও।

পাঠক আসুন, এবার আমরা জেগে উঠি।
আমরা কি এ রকম স্বপ্ন দেখতে পারি না অন্তত একটি দিনের জন্য? সব মতপার্থক্য, দূরত্ব কি ঘুচতে পারে না কেবল ঈদের দিনে?

কাজী আলিম-উজ-জামান: সাংবাদিক
alimkzaman@gmail.com



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews