বোরো ধান নিয়ে ভাবনা

খাদ্য নিরাপত্তা

দেশের প্রধান ফসল বোরোর উত্তোলন চলছে এখন। হাওরাঞ্চলে ধান কাটা দিয়ে এটা শুরু হয়েছে। কোনো দুর্যোগ হানা দেয়নি হাওরে। তবে কালবৈশাখী, শিলাবৃষ্টি ও ঢলের আশঙ্কায় অনেকে আধা পাকা ধান কেটে ফেলছে। অপুষ্ট ধান থেকে চাল মিলবে কম। এদিকে দেশের সিংহভাগ অঞ্চলে এপ্রিলজুড়ে নজিরবিহীন তাপপ্রবাহের পর রোববার রাতে রাজধানীতে ঝড় ও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। দেশের প্রায় সব বিভাগে চলতি সপ্তাহে এমন ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া দপ্তর। এ অবস্থায় বোরোয় বড় ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা অমূলক নয়।

বস্তুত দেশের কৃষি খাতে বৃষ্টিবিষয়ক অভূতপূর্ব সংকট দেখা দিয়েছে। কিছু ক্ষেতে পেকে ওঠা ধানের জন্য বৃষ্টি যেমন ক্ষতিকারক; তেমনি যে জমির ধান এখনও পাকেনি, তাতে বাড়তি সেচ দিতে হচ্ছে জলদি। পাকা ধান নিয়ে দুশ্চিন্তা অবশ্য কম। প্রয়োজনে যন্ত্র লাগিয়ে কেটে মাড়াই করা যাচ্ছে। তবে সেচ দিতেই হবে, এমন জমির পরিমাণ কম নয়। এপ্রিলের মধ্যভাগ থেকেই বলা হচ্ছে, তাপদাহে এসব জমিতে পানি ধরে রাখতে হবে। নইলে ধান চিটা হওয়ার আশঙ্কা। টানা উচ্চ তাপমাত্রায় অকালে ধান পাকার ঘটনাও ঘটতে পারে। অপুষ্ট আর অকালপক্ব ধান থেকে বাড়তে পারে ভাঙা চাল পাওয়ার হারও। এমনিতেই বিপুল পরিমাণ ভাঙা চাল তৈরি হয় প্রতিবছর। এবার সেটা বাড়বে। সঙ্গে চিটা হলে চালের উৎপাদন হ্রাস পাবে আরও।

অনাবৃষ্টিতে পর্যাপ্ত সেচ দিতে না পারলে রোগবালাই দেখা দেবে। বালাই ব্যবস্থাপনায় খরচ বাড়বে তখন। সমস্যা হলো, বাড়তি খরচ করতে চাইলেও অনেক ক্ষেত্রে সেচের ব্যবস্থা হচ্ছে না প্রথমত লোডশেডিংয়ের কারণে; দ্বিতীয়ত, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে চলে যাওয়ায়। লোডশেডিংয়ে ডিজেল দিয়ে সেচযন্ত্র চালানো যায় অবশ্য। আমাদের সিংহভাগ সেচযন্ত্র তো ডিজেলেই চলে। কিন্তু সাধারণ সেচযন্ত্রে এখন পানি তোলা যাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে অনেক গভীর থেকে পানি তুলতে সক্ষম ‘সাবমার্সিবল পাম্প’ ব্যবহৃত হচ্ছে। এটা কিন্তু শুধু গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত হওয়ার কথা!

তীব্র তাপপ্রবাহের শিকার যশোরসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জরুরি সেচ নিয়ে এমন সংকটের খবরই বেশি মিলছে। তাপপ্রবাহে অন্যান্য ফল-ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবরও উদ্বেগজনক। মাসের পর মাস খেটে, লোক খাটিয়ে এবং উপকরণ বাবদ অর্থকড়ি জুগিয়ে কৃষক যদি সফলভাবে ফসল তুলতে না পারে– এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে! আর সেটা যদি হয় বোরো। অনেক কৃষক নিজ পরিবারের বেশ ক’মাসের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে এ ফসল ব্যবহার করে। অংশবিশেষ হয়তো করে বিক্রি। এক শ্রেণির কৃষক আবার উৎপাদিত ধানের প্রায় পুরোটাই বিক্রি করে দায়দেনা মেটায় এবং অন্যান্য কেনাকাটা সারে। এদের ক্ষেত্রে ধানের লাভজনক দাম পাওয়ার প্রশ্নও রয়েছে। এমনিতেই বোরোয় উৎপাদন ব্যয় আউশ ও আমনের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। সরকার অবশ্য কিছু ভর্তুকি এখনও দিয়ে থাকে। উল্টোদিকে আবার দাম বাড়ানো হয়েছে ইউরিয়া, ডিজেল ও বিদ্যুতের। কৃষি শ্রমিকের মজুরিও বেড়েছে। এমন তাপপ্রবাহে কৃষি শ্রমিক পাওয়াও কঠিন। কমেছে তাদের উৎপাদনশীলতা। এ অবস্থায় বাড়তি সেচের বাধ্যবাধকতা ও বালাই ব্যবস্থাপনা বোরোর উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে আরও।

সরকার ইতোমধ্যে বোরো সংগ্রহের যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, তাতে নির্ধারিত দাম কি কৃষকের জন্য লাভজনক? সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জন্য এর গ্রহণযোগ্য দাম নির্ধারণ অবশ্য বরাবরই কঠিন। মুশকিল হয় তখন, যখন ধানের উৎপাদন মার খেলেও কৃষক লাভজনক দাম পায় না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছিল, এবার আবাদ বেশি আর ফলনও ভালো। এ অবস্থায় এপ্রিলে সহনীয় তাপপ্রবাহ থাকলেও বোরোর সফল উত্তোলন নিয়ে শঙ্কা ছিল না। এতে বাড়তি সেচ বাবদ কৃষকের ব্যয়টাও বেঁচে যেত; সঙ্গে তার ভোগান্তি ও দুর্ভাবনা। উৎপাদন স্বাভাবিক রেখে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের দেশের খাদ্য নিরাপত্তা অটুট রাখায় তার এ ভূমিকার কী মূল্যায়ন করি আমরা? তাপপ্রবাহে বিদ্যুতের ঘাটতি হলে তাকেই বরং শিকার হতে হয় লোডশেডিংয়ের!

এ অবস্থায় সব কৃষক যে অগত্যা ধান-চাল উৎপাদনেই নিমগ্ন থাকবে, তা নয়। দেশে ভুট্টার আবাদ বাড়ছে। এতে ব্যয় ও পেরেশানি কম এবং দাম মিলছে ভালো। পাটের আবাদও বাড়ছে নতুন করে। একই সময়ে ফল আর সবজির উৎপাদনও কম হচ্ছে না। তবে আশার কথা, এ দেশে ধানের উৎপাদন বাড়ছে এমনকি চীন, ভারতের চেয়ে বেশি হারে। আর ধান-চাল উৎপাদনে আমরা আছি তৃতীয় স্থানে। কোনো কোনো বছর চাল আমদানি না করলেও চলে। তবে উৎপাদন, চাহিদা ও মজুত-সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্যের ঘাটতি রয়েই গেছে। তাতে চালের দাম হঠাৎ বেড়ে গিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হতেও দেখা যায়। কিছুদিন আগে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সরকার অনুমতি দেয় কিছু চাল আমদানির। তবে সেটা শুরু হয়নি সম্ভবত এ জন্য, বিশ্ববাজারে চালের দাম এখনও চড়া। বড় শুল্ক ছাড়ে আনলেও প্রতিযোগিতামূলক দামে সেটা নাকি বেচা যাবে না।

হাওরে বোরো ধান কাটছে কৃষক	সমকাল

এ অবস্থায় ভালো হয় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বোরোর উৎপাদন নিশ্চিত করা গেলে। কিন্তু জুন পর্যন্ত দেশের সিংহভাগ অঞ্চলের ওপর দিয়ে থেকে থেকে তাপপ্রবাহ বইবে বলে প্রক্ষেপণ করা হচ্ছে। তাতে প্রায় ৫০ লাখ টন ধান উৎপাদন কমতে পারে বলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন অগ্রগণ্য কৃষি অর্থনীতিবিদ এমএ সাত্তার মণ্ডল। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ আমাদের খাদ্যশস্য উৎপাদনের বেশ নির্ভরযোগ্য তথ্য দিয়ে থাকে। তারা কিন্তু বলেছিল, এবার বোরো উৎপাদন হতে পারে ২ কোটি ৫ লাখ টন। সরকারি লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ২২ লাখ টন। এর যে কোনো একটি থেকে ৫০ লাখ টন কম উৎপাদন হলে সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক।

তখন জরুরি ভিত্তিতে চাল আমদানি করতে হবে এর দামের নতুন ঊর্ধ্বগতি রোধে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনাটা হয়ে উঠবে আরও চ্যালেঞ্জপূর্ণ। এদিকে গরিবের হাতে ভর্তুকিতে ও বিনামূল্যে চাল তুলে দিতে গিয়ে সরকার তার মজুত ফেলেছে কমিয়ে। ফলন বিপর্যয় ঘটলে মজুত সন্তোষজনক পর্যায়ে আনতে তাকেও সরাসরি আমদানিতে যেতে হবে। কিন্তু কোত্থেকে আনবে চাল? প্রধান রপ্তানিকারক ভারত নন-বাসমতী চাল রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দিয়ে রেখেছে। এ অবস্থায় থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম থেকে আনা গেলেও তারা দাম হাঁকবে বেশি। মিয়ানমার, চীন, ইন্দোনেশিয়াসহ গোটা অঞ্চলই এখন অত্যধিক তাপপ্রবাহের শিকার। ধান-চাল ফলানো এ দেশগুলোয় উৎপাদন হ্রাসের ঘটনাই নাকি বেশি ঘটবে এবার। তাহলে কে কার কাছ থেকে চাল কিনবে? আমাদের আমদানি সক্ষমতাও ইতোমধ্যে ক্ষয়প্রাপ্ত ডলার সংকটে। আরেক জরুরি খাদ্যপণ্য গমের প্রায় ৮০ শতাংশই আমদানি করতে হচ্ছে। দেশে এর উৎপাদন কমছেও। অনেকে মনে করেন, গমের দাম বাড়ার প্রেক্ষাপটে আটা-ময়দার পরিভোগ কমায় হালে চালের চাহিদা আরও বেড়েছে। এ অবস্থায় যে কোনো মূল্যে চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় রাখা জরুরি। চলমান তাপপ্রবাহে বোরোর ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হলে সামনে আউশ ও আমন মৌসুমে বাড়তি উৎপাদনের সুকঠিন চ্যালেঞ্জও নিতে হবে।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, বিশ্লেষক



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews