মাহাথির মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দুই-আড়াই বছর পর আমি মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলাম। তা এখন থেকে প্রায় ৩৫ বছর আগের কথা। তখন মালয়েশিয়া দেশটির এখনকার মতো অবস্থা ছিল না। মাহাথিরেরও নামডাক হয়নি। তিনি তাঁর আগের তিন প্রধানমন্ত্রীর মতোই আর একজন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর পূর্বসূরি আবদুল রহমান, আবদুল রাজ্জাক এবং হোসেন ওন দেশ গঠনে তাঁদের মতো ভূমিকা রেখেছেন। আমি যখনকার কথা বলছি তখন মাহাথির তাঁর উন্নয়ন পরিকল্পনার স্বপ্নের জাল মাথার মধ্যে বুনছিলেন।

আশির দশকের শুরুর মালয়েশিয়া বা কুয়ালালামপুর ছিল অন্য রকম। কুয়ালালামপুরের আশপাশের বিস্তীর্ণ জঙ্গলে বন্য প্রাণীরা নির্ভয়ে বিচরণ করত। পর্যটকেরা তা উপভোগ করতেন। নতুন স্থাপনা উঠছিল, কিন্তু এখনকার মতো কুয়ালালামপুরে আকাশছোঁয়া অট্টালিকা ছিল না। সরকারের প্রশাসনে উচ্চশিক্ষিত কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল কম। ১৯৭২ বা ৮২-তে বাংলাদেশে যত উচ্চশিক্ষিত কর্মকর্তা-কূটনীতিবিদ-প্রকৌশলী ছিলেন, ওই সময় মালয়েশিয়ায় তার চার ভাগের এক ভাগও ছিলেন না। তবে কর্মকর্তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা ছিল। তা না থাকলে মালয়েশিয়ার অবস্থা বাংলাদেশের দশা হতো।

মাহাথিরের ক্ষমতা গ্রহণের সময় তাঁর দেশের হাসপাতালগুলোয় যথেষ্ট ডাক্তার ছিলেন না। দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন অল্প। স্থপতি ছিলেন হাতে গোনা। তাই মালয়েশিয়ার সরকার উচ্চশিক্ষিত আমলা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার প্রভৃতি তৈরি করতে তরুণ-তরুণীদের বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকায় বৃত্তি দিয়ে পাঠাত। আমাদের ঢাকা, চট্টগ্রাম, সলিমুল্লাহ, রাজশাহী, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাস করে দেশে গিয়ে সরকারি হাসপাতালে যোগ দিয়েছেন অনেকে। তাঁদের কেউ কেউ বাংলাদেশ থেকে শুধু ডিগ্রি নিয়ে যাননি, উপরি হিসেবে নিয়ে গেছেন স্বামী, কেউ নিয়ে গেছেন বাঙালি বউ। বাংলাদেশি শিক্ষিতদের তখন মালয়েশিয়া সরকার খুবই কদর করত।

সমুদ্রবেষ্টিত মালয় উপদ্বীপের সভ্যতা ও সংস্কৃতি বাংলার মতো প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ছিল না। যদিও প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল বিপুল। রাবার, টিন, পাম তেল, বনভূমিতে কাঠ ছিল প্রচুর। দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল কিন্তু মানবসম্পদ ছিল না। সেই প্রাকৃতিক সম্পদ টিন, রাবার প্রভৃতি ব্রিটিশ বেনিয়ারা লুট করে নিয়ে যেত। যারা সম্পদের মালিক সেই মালয়বাসী নিজের হাতে তা ব্রিটিশ জাহাজে তুলে দিয়েছে। বিনিময়ে যেটুকু মজুরি পেত তা দিয়ে সন্ধ্যার পর বসে বসে নেশা করে ঝিমাত। নেশাখোর জাতি হিসেবে আদি মালয়বাসীর দুর্নাম ছিল। মালয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষিতের হার ছিল খুব কম।

আমি যখন মালয়েশিয়ায় যাই তখন একটি খবর প্রতিদিন শিরোনাম হচ্ছিল। তিন ব্রিটিশ ও অস্ট্রেলীয় নাগরিককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাঁরা হেরোইন নিয়ে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করেন, এই অভিযোগে। তাঁদের মৃত্যুদণ্ড মওকুফের জন্য রানি এলিজাবেথ, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরের কাছে আকুল আবেদন জানান। মাহাথির তাঁদের সে আবেদন অগ্রাহ্য করেন।

মালয়েশীয় সরকার আইন করেছিল যদি কারও কাছে, মালয়েশিয়ার নাগরিক হোক বা বিদেশি হোক, ৭০ গ্রামের বেশি হেরোইন বা ওই জাতীয় মাদকদ্রব্য পাওয়া যায় তাহলে আর কোনো কথা নেই, সোজা প্রাণদণ্ড। তার ফলে প্রথম দিকে বহু নরনারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। মাদক যদি সহজলভ্য না হয় তাহলে তা সেবন করে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকার সুযোগ কোথায়? সুতরাং আগে দেশকে করা চাই মাদকমুক্ত।

মাহাথির যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন তাঁর দেশে জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ। সিআইডির এক গবেষকের মতে, আজ বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা সরকারি হিসাবে ৬৬ লাখ। তবে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে মনে করে।

মানুষ কী খাবে আর কী খাবে না, সেটা তার মৌলিক অধিকার। যার খুশি রসগোল্লা খাবে, যার ইচ্ছা তামাক খাবে। মৌলিক অধিকার বলতে যা বোঝায় তার ষোলো আনা গ্যারান্টির দেশ এই বাংলাদেশে মাদকসেবন অনেকটাই ফান্ডামেন্টাল রাইট। অফিসকক্ষে, আদালত প্রাঙ্গণের বটগাছের নিচে, হাটে-বাজারে, হাসপাতালের চত্বরে, বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গোপনে-আড়ালে-আবডালে নয়, দিন-দুপুরে পরমানন্দে চলছে মাদক উপভোগ।

মাদকসেবীর সংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে ২০২১ সালে তা ৩ কোটি অতিক্রম করবে এবং ২০৪১ সালে কত হবে, তা এখনই অঙ্ক কষে বলা সম্ভব। বিষয়টি যে রকম অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে তাতে ২০৩১ সাল নাগাদ পরিবারে ভাই-বোন, বাপ-বেটা, শ্বশুর-পুত্রবধূ, শাশুড়ি-জামাতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী একত্রে মাদক সেবনে সংকোচ বোধ করবে না।

শুধু ইয়াবা-বাণিজ্য করেই বাংলাদেশের উচ্চ-মধ্য আয়ের রিপাবলিক হওয়া সম্ভব। তবে একই সঙ্গে হবে উচ্চ মাদকসেবীদের দেশও। চাটগাঁর এক ইয়াবা ব্যবসায়ী টাটা, বিড়লা, আদমজী, বিল গেটসকে হারাতে পারতেন, কিন্তু ২০১৫-এর আগস্টে র্যাব ও বিজিবির সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। ‘এক বছরের মধ্যে ওই ব্যবসায়ীর ১২টি ব্যাংক হিসাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢুকেছে ১১১ কোটি টাকা।’ [প্রথম আলো, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৮] বর্তমান বিশ্বের ধনকুবেরদের একজন ওই ‘ব্যবসায়ী’ ছিলেন প্রকাশ্যে একটি ছোট্ট মোবাইল যন্ত্রাংশের দোকানের স্বত্বাধিকারী। তাঁর দোকানের আয়তন ছিল ১২ বাই ১৩ ফুট। ‘ওই দোকানের নামেই বিভিন্ন ব্যাংকে তার ১২টি হিসাব খোলা হয়েছে। ওই হিসাবগুলোতেই ইয়াবা বিক্রির টাকা লেনদেন হতো।’

যেকোনো বস্তুর চেয়ে বর্তমানে বঙ্গভূমিতে ইয়াবা ব্যবসাই সবচেয়ে লাভজনক। খুচরা খরিদদারদের কাছে বেচাবিক্রি যা হওয়ার তা অব্যাহতভাবে চলছেই, তবে মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইয়াবার পাইকারি মহাজনদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। তাতে কিছু ইয়াবা বড়ি আটক করা হয়। এখন বছরে উদ্ধার হচ্ছে মাত্র ৪ কোটি বড়ি।

প্রথম আলো তার ‘বছরে ইয়াবা-বাণিজ্য ৬ হাজার কোটি টাকা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ‘জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (ইউএনওডিসি) মতে, উদ্ধার হওয়া মাদকের এই সংখ্যা বিক্রি হওয়া বড়ির মাত্র ১০ শতাংশ। সেই হিসাবে বছরে শুধু ইয়াবা বড়িই বিক্রি হচ্ছে ৪০ কোটির মতো, যার বাজারমূল্য প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা (প্রতিটি দেড় শ টাকা দাম হিসাবে)। এই টাকার অর্ধেকই চলে যাচ্ছে ইয়াবার উৎসভূমি মিয়ানমারে। ইয়াবা বড়ির পেছনে মাদকসেবীদের বছরে যে খরচ, তা বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) বার্ষিক বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ (২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিজিবির বাজেট ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা)। আর পুলিশের বাজেটের প্রায় অর্ধেক।’

বিত্তবান বাংলাদেশের কিছু অর্থ বন্ধুরাষ্ট্রে চলে যাচ্ছে এবং বন্ধুদেশ থেকে আসছে স্রোতের মতো বাংলাভাষী বিতাড়িত রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ-সেটা কম আনন্দের কথা নয়। বন্ধুই তো করবে বন্ধুর উপকার। ‘জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয়ের তথ্যমতে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশে ইয়াবা সরবরাহ করে মিয়ানমার। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার শুরু হয় ২০০৬ সাল থেকে। ২০১২ সালে চীন ও থাইল্যান্ডের মধ্যে চুক্তির পর মিয়ানমারের মাদক উৎপাদনকারীদের জন্য সেসব দেশে পাচার কঠিন হয়ে পড়ে। তখন তারা বাংলাদেশকেই মাদক পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। মিয়ানমারের ওয়া এবং কোকাং নামের আদিবাসী সম্প্রদায় এই মেথাএম্ফিটামিন পিল বা ইয়াবা উৎপাদনকারী। এই দুই গোষ্ঠীর লোকজন একসময় আফিম ও হেরোইন উৎপাদনে জড়িত ছিল।’ [প্রথম আলো]

পুলিশের সিআইডির গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০১০ সালে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ছিল ৪৬ লাখ, বর্তমানে তা ৬৬ লাখ। এদের মধ্যে ১৫ বছরের বেশি বয়সের মাদকসেবী ৬৩ শতাংশের বেশি। গত পাঁচ বছরে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ২৫৪ ব্যক্তির বিরুদ্ধে। শুধু মামলা করেই মাদকের বিস্তার রোধ সম্ভব নয়। সেটা অনেক উপায়ের একটি মাত্র।

মাদক নির্মূল শুধু মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাজ নয়। শুধু পুলিশও পারবে না। গবেষণা করে, লেখালেখি করে, আলোচনা করে মাদকের অভিশাপ থেকে জাতিকে রক্ষা করা যাবে না। জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন সমন্বিত ও সর্বাত্মক উদ্যোগ। প্রশাসন ও পুলিশকে থাকতেই হবে। তার বাইরে মিশনারি মনোভাব নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অভিযানে নামতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা জানেন তাঁদের এলাকায় কারা মাদক ব্যবসা করে এবং কারা সেবনকারী। উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধিরাও দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। ভোটে নির্বাচিত হোন বা বিনা ভোটে নির্বাচিত হোন সংসদ সদস্যদের নৈতিক দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকদের বেয়াদবির নামান্তর।

মাদক একটি জাতি, লিঙ্গ ও ধর্মনিরপেক্ষ দ্রব্য। নারী, পুরুষ ও সব ধর্মের মানুষই এর শিকার। সুতরাং ধর্মীয় নেতাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আগে বিভিন্ন বিষয়ে ভূমিকা রাখতেন। এখন মোটরসাইকেলে ঘোরাফেরা করা দলীয় ক্যাডারদের দাপটে তাঁরা মান-ইজ্জত বাঁচাতে গৃহবন্দী। সুতরাং সমাজের যেকোনো উদ্যোগ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সদিচ্ছা ছাড়া বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আমাদের ক্ষমতাসীন দল সব সময় চেঙ্গিস খাঁর বাহিনীর মতো পরাক্রমশালী। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, মিয়ানমার সীমান্তবর্তী সরকারি দলের অনেক নেতা-কর্মী ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ধর্মবাবা।

মাদকাসক্তি কারও ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়। একজন মাদকসেবীর কারণে সমস্ত পরিবারে নেমে আসে অশান্তি। ঘটছে খুনখারাবির মতো অপরাধ। বাড়ছে নারী নির্যাতন। শহরে ছিনতাই ও দস্যুবৃত্তি এবং মফস্বলে মাদকাসক্তদের উৎপাতে বহু মেয়ের স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, স্কুলের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই বিষ ঢুকে গেছে। শিক্ষকেরাও বাদ নেই। মাদকাসক্ত হওয়া মানে তিলে তিলে জীবনীশক্তি শেষ করে অকালমৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়া।

কোনো জাতির আর্থসামাজিক সমৃদ্ধি আসে তার কর্মক্ষম মানুষদের উৎপাদনমুখী শ্রমের ফলে। যে দেশের এক-চতুর্থাংশ যুবসমাজ অকর্মণ্য ও মাদকাসক্ত, মাদক নিয়ে ঝিমায় বা ঘুমায়, সে জাতির উন্নতির প্রশ্নে সংশয় থাকবেই। বাংলাদেশে জঙ্গির চেয়ে মাদক অনেক বড় সমস্যা। সমাজকে মাদকমুক্ত করা না গেলে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনাই দীর্ঘমেয়াদি সুফল বয়ে আনবে না।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews