অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসিমুল ইসলাম

অনেকেই ভাবেন ফরেনসিকের লোক মানেই ক্রিমিনাল। আজ আনুশকার অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে ভাবতে বসে নিজেকে ক্রিমিনালই মনে হচ্ছে। আমি সাধারণত ঘটনার আদ্যোপান্ত না জেনে কোনো মন্তব্য করি না। সে কারণেই আনুশকার মৃত্যু এবং ময়নাতদন্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না। এ ঘটনাটি আমার মালয়েশীয় মর্গে এলে কীভাবে ফরেনসিক তদন্ত এগিয়ে নিতাম সে ব্যাপারে কিছু না বললেই নয়। আমি জানি, এ ঘটনায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রয়েছে এবং এটাও জানি হত্যাকারীর স্বীকারোক্তির পরও মৃত ব্যক্তিকে (একাধিক ঘটনায়) জীবিত পাওয়া যায়. আমার জানা মতে ঘটনাটি

নিম্নরূপ:
‘১৭-১৯ বছর বয়স্ক আনুশকা ফোন পেয়ে তার বন্ধুর ধানমন্ডির বাসায় গিয়েছিল, সেখানে তার মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। যোনি এবং মলদ্বার দিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার বলেছেন, এটি হত্যা, ধর্ষণ এবং বিকৃত যৌনাচার’।

আমি বিদেশে এই মামলাটি অনুসন্ধানের জন্য এলে একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমাদের করণীয় কি সেটি লিখতে কলম ধরেছি। এ থেকে শিক্ষণীয় কিছু থাকলে থাকতেও পারে। তবে সে ক্ষেত্রে দেশে কীভাবে অনুসন্ধান বা তার ব্যত্যয় হয়েছে তা মিলিয়ে দেখতে পারেন। দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, এ ধরনের ঘটনার সমাধান অতি সহজ এবং এ ঘটনা থেকে একজন ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট সুনাম অথবা দুর্নাম দুটোর যে কোনো একটি অর্জন করতে পারেন।

মনে রাখতে হবে, এসব ঘটনায়, ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। ময়নাতদন্ত শেষে সাংবাদিকদের কাছে বা ক্যামেরার সামনে ময়নাতদন্তের সংক্ষিপ্ত ফলাফল প্রকাশ করা গেলেও মতামত প্রকাশ নিয়মসিদ্ধ নয়। বিজ্ঞানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর নিশ্চিত হয়ে তবেই মতামত লেখার দিকে এগোতে হয়। যেমন- এ ঘটনায় জানতে হবে-

১. মেয়েটি কি স্বেচ্ছায় যৌন মিলনে অংশ নিয়েছিল!

২. রক্তপাতের উৎপত্তিস্থলের জখম কি পুরুষাঙ্গ বা অন্য কিছু দ্বারা সৃষ্ট

৩. মেয়েটি কি এবরশন করতে সেখানে যেতে পারে?

৪. এবরশনের সময় কি এ ধরনের জখম হতে পারে?

৫. মেয়েটি কি আসলেই যৌন নির্যাতনের শিকার ছিল?

৬. মেয়েটি নেশাসক্ত বা নেশাগ্রস্থ ছিল?

৭. যৌনাঙ্গের ভিতরে কি বীর্য নিশ্চিত হওয়া গেছে?

৮. ধর্ষণকারীর পুরুষাঙ্গ এর সাইজ কি পরীক্ষা করা হয়েছে?

৯. মেয়েটির যৌনপথ এবং জরায়ুর গঠন কি স্বাভাবিক ছিল?

তাছাড়া সুরতহাল থেকে উদ্ভূত প্রশ্নসমূহ, ঘটনা যা জানা গেছে তাতে করে এটি ধর্ষণ, সোডোমি, এডাল্টারি বা পাশবিক নির্যাতনের যে কোনোটি হতে পারে। অথচ অনুসন্ধানকারীরা সবাই ক্যামেরার সামনে যেভাবে ধর্ষণ বলে মতামত দিচ্ছেন তা তদন্তের স্বার্থে বড়ই বেমানান। মনে রাখতে হবে, মেয়েটির অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, তাই মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ে এ ময়নাতদন্ত করা। অনুসন্ধানের শুরুতেই ময়নাতদন্তকারী যে ধর্ষণ বলে মতামত দিচ্ছেন, ফরেনসিক বিদ্যা কি তাকে সেই কথা বলার অনুমতি দিয়েছে? তারা কি পরিস্থিতিকে জটিল করে ফেলছেন না? এখন আদালত যদি বলে এটি ধর্ষণ নয় তখন কি আদালত বা অনুসন্ধানকারীরা জনমনে আস্থা সংকটে পড়বেন না!

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমরা শুধু ভিকটিম এর সাথে যৌন নির্যাতন বা যৌন মিলন হয়েছিল কিনা তা সংক্ষিপ্তাকারে হা অথবা না এর মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারি। যদিও পরীক্ষাসমূহের পূর্ণ প্রতিবেদন হাতে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাই শ্রেয়। যদি ভুল দেখে না থাকি তাহলে একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা গেল, ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার বলেছেন এটি হত্যা, ধর্ষণ এবং বিকৃত যৌনাচার, যা বলার এখতিয়ার একান্তভাবে আদালতের। একজন ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট কোনভাবেই এগুলি বলতে পারে না। এগুলি বলার সপক্ষে তার কি যুক্তি রয়েছে তা তিনিই বলতে পারবেন। প্রকৃতপক্ষে, ফরেনসিক প্রতিবেদনই সব নয়, আদালত আনুষঙ্গিক এক্সিবিট এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞের প্রতিবেদন বিবেচনা করে তার রায় দেন, এটাই নিয়ম।

ভিডিও ক্লিপে দেখা গেল, ডাক্তার বলছেন ডিএনএ, মাইক্রোবায়োলজি এবং শারীরিক পরীক্ষার দ্বারা ধর্ষণ নিশ্চিত করা হয়। দুঃখিত, একমত হওয়া গেল না। ধর্ষণের সংজ্ঞা সেটি সমর্থনও করে না। মেয়েটির বয়স ১৭ কিম্বা ১৯ যাই হোক না কেন তার সম্মতি বা অসম্মতির উপর অনেককিছু নির্ভর করবে। সম্মতিতে যৌনমিলন হলে এটি এডাল্টারি বা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের অন্তর্ভুক্ত হবে। যেহেতু শারীরিক জখম বা প্রতিরোধের কোন জখম পাওয়া যায় নি তাই স্ত্রী অঙ্গের ভিতর বীর্য এর উপস্থিতি পাওয়া গেলেও এটিকে ধর্ষণ প্রমাণ করা খুব সহজ হবে না।

বিদেশে ধর্ষণের আলামত এবং পরীক্ষা সমূহের ফলাফল হাতে না পেয়ে শুধু ময়না তদন্ত করে কেউ হত্যা, ধর্ষণ এবং বিকৃত যৌনাচার সম্পর্কে মতামত দিতে পারে না বা দেওয়া উচিত নয়। ভিডিও ক্লিপে দেখা গেল, তাৎক্ষণিকভাবে এক্সরে করা সম্ভব হয় নি। ভিডিওতে বলা হলো, ডিএনএ, মাইক্রোবায়োলজি এবং শারীরিক পরীক্ষায় ধর্ষণ নিশ্চিত হয়, ডিএনএ পরীক্ষা করতে ২৫ দিন থেকে একমাস সময় লাগে। তথ্যগুলোও সত্য নির্ভর নয়। এখানে বলা প্রয়োজন যে, ক্রিকেটে এলবিডাবলু আউট দিতে যেমন কিছু শর্ত মানতে হয় ঠিক তেমনি ধর্ষণ নির্ণয়েও মানতে হয় কিছু শর্ত।

ধর্ষণের শর্তানুযায়ী বয়সের পাশাপাশি জানতে হয় মেয়েটির সাথে অনিচ্ছায় অথবা জোরপূর্বক অথবা তাকে প্রতারণার মাধ্যমে যৌন মিলন করা হয়েছিল কি না। মেয়েটির মানসিক অবস্থাই বা কেমন ছিল। আলোচ্য ঘটনায় ধর্ষণের শর্ত কি নিশ্চিত হওয়া গেছে? তা যদি না হয়, তাহলে ছেলেটিকে ধর্ষক বলা কি এই মুহূর্তে যুক্তিযুক্ত! ঘটনার ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার যা বলেছেন, সকল পরীক্ষা শেষে তা যদি সত্য বলে প্রমাণিত হয় তাহলেও বিদেশে পাবলিকলি মিডিয়ার সামনে এভাবে বলা হয় না। ফরেনসিক পরীক্ষায় মৃত্যুর কারণ বলা হয়, ধর্ষণ হয়েছে কি হয়নি তা একান্ত আদালতের এখতিয়ার।

পরিশেষে বলব, ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট হিসেবে আমাদেরকে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করতে হয় যা সহজ কাজ নয়। এক্ষেত্রে প্রথমেই ঘটনাকে স্বাভাবিক ধরে এগুতে হয়। অথচ আলোচিত ঘটনায় আমরা কি দেখলাম? প্রথমেই ঘোষণা হল ধর্ষণ, তারপর হত্যা, ধর্ষণ এবং বিকৃত যৌনাচার তারপর এডাল্ট টয়। লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে এর কোনটাই স্বাভাবিক ভাবনা নয়। এত ছটফট করে কি তদন্ত হয়? সবাই হয়ত ভাবছেন এখানে স্বাভাবিক ঘটনা কি হতে পারত।! আমি মনে করি, স্বাভাবিক ঘটনাটি হল, যেহেতু দিহান এবং মেয়েটি পূর্ব পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ ছিল। ঘটনার দিন দুজন দুজনকে কাছে পেয়ে উভয়ের সম্মতিতে তারা শারীরিক মিলনে ব্যর্থ হলে চেষ্টা করে পুরুষাঙ্গের ন্যায় শক্ত কোন বস্তু দিয়ে যোনিপথ ব্যবহার উপযোগী করতে চেষ্টা করতে আর তখনই বিপত্তি ঘটেছে। এর কারণ দিহানের এনাটমিকাল জ্ঞানের অভাব আর মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ।

ডিবিসির সাতকাহনে শুনলাম ময়নাতদন্তকারী বললেন, গ্রুপ সেক্স নির্ণয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করে একাধিক ব্যক্তির বীর্য নিরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন। বীর্য পেলে নিশ্চিত হবেন পুরুষাঙ্গ এবং ফরেনবডি ব্যবহার উভয়ই ব্যবহৃত হয়েছে। ময়নাতদন্তকারী হয়ত ভুলে গেছেন, তারা কনডম ব্যবহার করতে পারে এবং ধর্ষণের সংজ্ঞায় পুরুষাঙ্গ প্রবেশের বাধ্যকতা আছে, বীর্যপাতে নয়।

পরিশেষে বলব, ভুল তথ্য সরবরাহের চেয়ে ময়নাতদন্ত না করা শ্রেয়। কেননা, ভুল তথ্য সঠিক তদন্তকে শুধু ব্যাহতই করে না, বিপথেও পরিচালিত করে। একটি হত্যাকাণ্ডে ময়নাতদন্ত অতীব জরুরি কিন্তু তা না হলে তদন্ত থেমে থাকবে না। যেমন বৈজ্ঞানিক উপায়ে বয়স নির্ধারণে এক্সরে অতীব জরুরি ছিল। অথচ তা না করেই ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। ফোনে অবৈজ্ঞানিক উপায়ে বয়স নির্ধারণ করতে হচ্ছে যেখানে ভুলের সম্ভাবনা অনেক বেশি। যত কনফিডেন্টলিই বলেন না কেন, দাঁত থেকে পাওয়া তথ্যর উপর আস্থা রাখা গেলেও, জন্ম নিবন্ধন বা স্কুলের সার্টিফিকেট এর উপর আস্থায় বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

বাংলাদেশে ফরেনসিক শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে এর ভূমিকা অপরিসীম। দুর্নীতি, অযোগ্যদের রাজনৈতিক কারণে পদায়ন আর পরীক্ষা পাস এর অসুদোপায় নিয়ে যে মুখরোচক ঘটনা শোনা যায় তা যদি সত্য হয় তাহলে এ বিষয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। সংশ্লিষ্টরা ব্যাপারটি ভেবে দেখতে পারেন। আমার এ লেখায়, অনেকেই আমাকে ভুল বুঝতে পারেন। তাদের বলছি, আমি এই বিষয়ের উন্নতি চাই। আপনাদের মত আমিও অপরাধীর শাস্তি চাই। তবে বিনা অপরাধে অথবা কম অপরাধে কেউ যেন বেশি শাস্তি না পায়।

ঘটনার উপর প্রচারিত ভিডিও ক্লিপ এবং তথ্য উপাত্ত পাঠিয়ে যারা আমাকে সহযোগিতা করেছেন, তাদেরকে ধন্যবাদ।

লেখক : ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন প্রধান। বর্তমানে অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন, ইউনিভার্সিটি টেকনোলোজি মারা তে কর্মরত।
[email protected]

এইচআর/এমএস



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews