গাজায় ইসরায়েলের বিরামহীন সামরিক আক্রমণ মৃত্যু, ধ্বংস এবং অনাহারের চিহ্ন রেখে চলেছে। অনেকেই এটাকে ইচ্ছাকৃতভাবে জাতিগত নির্মূল অভিযান হিসাবে বর্ণনা করছে। এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখী হয়েও মূলত নিষ্ক্রিয় রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
মেডিকেল সূত্রমতে, কেবল সোমবারই ইসরায়েলি হামলায় আরও কয়েক ডজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। মাত্র একদিন আগে, ইসরায়েলি সেনারা অবরুদ্ধ উপত্যকা জুড়ে শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। এরমধ্যে ৯২ জন নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকও ছিল। উত্তর গাজার জিকিম ক্রসিংয়ের কাছে এবং রাফাহ ও খান ইউনিসের ত্রাণ বিতরণ পয়েন্টে মরিয়া হয়ে খাবার খুঁজতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে তারা নিহত হয়।
ইসরায়েলের শ্বাসরুদ্ধকর অবরোধে মানবিক সংকট ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অবৈধ রাষ্ট্রটি গাজাকে মহাদুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিংগুলি সিল করে দেওয়া এবং সাহায্য প্রবেশ কঠোরভাবে সীমাবদ্ধ করার ফলে গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দা তাৎক্ষণিক অনাহারের মুখোমুখি।
ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সহায়তা করা জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডাব্লিউএ সতর্কবার্তা জারি করে জানিয়েছে, তারা গাজার ভেতর থেকে - এমনকি তাদের নিজস্ব কর্মীদের কাছ থেকেও ‘অনাহারের মরিয়া বার্তা’ পাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে সংস্থাটি লিখেছে, ‘‘খাদ্যের দাম ৪০ গুণ বেড়েছে। এদিকে, গাজার ঠিক বাইরে, ইউএনআরডাব্লিউএ এর গুদামে মজুদ করা যে খাবার রয়েছে, তা তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে সমগ্র জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত।’’
এই সংকটকে ‘মানবসৃষ্ট’ আখ্যা দিয়ে ইউএনআরডাব্লিউএ জরুরি হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, ‘‘গাজার দুর্ভোগ মনুষ্যসৃষ্ট এবং এটি বন্ধ করতে হবে। অবরোধ তুলে নিন এবং নিরাপদে এবং ব্যাপকভাবে সাহায্য পৌঁছাতে দিন।’’
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি) একই ধরনের সতর্কবার্তা দিয়েছে। ফিলিস্তিনে ডাব্লিউএফপি-এর প্রতিনিধি আন্তোইন রেনার্ড অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেম (আল-কুদস) থেকে আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘‘হতাশার মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, গাজায় আসা যেকোনো সাহায্য পৌঁছানোর জন্য মানুষ তাদের জীবনের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। ধারণা দেওয়ার জন্য বলছি, ১ কেজি আটার মূল্য বর্তমানে ১০০ ডলার।
রেনার্ড আরও বলেন, অনেক পরিবার খাদ্য ছাড়াই দিন কাটাচ্ছে, প্রতি তিন দিনে খাবার খেয়ে বেঁচে আছে। তিনি উল্লেখ করেন, খুব সীমিত সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবী রান্নাঘর এখনও চালু রয়েছে। বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে অপুষ্টির হার বাড়ছে এবং বেহুশ হয়ে পড়ে ক্রমশ সাধারণ হয়ে উঠছে।
‘‘(অপুষ্টির) সম্মুখীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আমরা সত্যিই দেখতে পাচ্ছি যে পরিস্থিতি সত্যিই এমন পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে যা আমরা আগে কখনও দেখিনি’’ বলেন তিনি।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতি সত্ত্বেও, ইসরায়েল নৃশংস সামরিক অভিযান অব্যাহত রেখেছে। চ্যানেল ১২ জানিয়েছে, ইসরায়েলি চিফ অফ স্টাফ ইয়াল জামির স্থল অভিযানের একটি নতুন পর্যায়ের প্রস্তাব করেছেন, যাকে ইসরায়েলি সূত্র ‘গাজা দখলের পরিকল্পনা’ হিসাবে বর্ণনা করেছে।
২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার ৫৯ হাজারের অধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ এবং আইনজ্ঞরা ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমি থেকে জোরপূর্বক বের করে আনার প্রচেষ্টায় ইসরায়েল ‘অনাহারকে যুদ্ধের অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ করেছেন। এটা এমন একটি কৌশল যাকে অনেকেই এখন প্রকাশ্যে গণহত্যা হিসাবে চিহ্নিত করছেন।
এই মাসের শুরুতে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের জন্য জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রান্সেসকা আলবানিজ গাজায় ইসরায়েলের চলমান ‘গণহত্যা’ বন্ধে অবিলম্বে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তবুও, ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসন এবং অনাহার নীতি অব্যাহত রয়েছে। কিছু পশ্চিমা শক্তি- বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অটল সমর্থনের মাধ্যমে এটা আরও শক্তিশালী করা হয়েছে।
সূত্র: তেহরান টাইমস