ছবির উৎস, Sailen Sarkar
ছবির ক্যাপশান,
নিরাতন বেওয়া সেসময় ক্ষুধার্ত সন্তানদের খাবার দিতে মাদের সংগ্রামের কথা জানান
৫৪ মিনিট আগে
১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষে পূর্ব ভারতে ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পাশাপাশি এটাকে দেখা হয় মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বেসামরিক মানুষ মারা যাবার ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে।
এনিয়ে কোন স্মৃতিস্তম্ভ নেই, যাদুঘর নেই এমনকি বিশ্বের কোথাও এই মারা যাওয়া মানুষগুলো স্মরণে একটা ফলকও করা হয়নি।
তবে এখনো সেই ঘটনার স্বাক্ষী কেউ কেউ বেঁচে আছে এবং খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই একজন তাদের গল্পগুলো সংগ্রহের কাজে নেমে পড়েছেন।
“অনেক মানুষই তাদের ছেলে ও মেয়েদের বিক্রি করে দেয় শুধু সামান্য কয়টা চালের জন্য। অনেকের স্ত্রী, তরুণীরা পালিয়ে যান এমনে অনেক মানুষের সাথে যাদের তারা চিনতো অথবা চিনতো না।”
বিজয়কৃষ্ণ ত্রিপাঠি বর্ণনা করছিলেন বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় মানুষ কতোটা মরিয়া হয়ে গিয়েছিল খাবারের খোঁজে।
তিনি তার নিজের বয়স বলতে পারেন না, তবে তার ভোটার কার্ড বলছে তার বয়স ১১২ বছর। সেই ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ যারা মনে করেছেন তাদের সর্বশেষ প্রতিনিধির একজন বিজয়কৃষ্ণ।
তিনি খুব আস্তে আস্তে বাংলার জেলা মেদিনীপুরে তার বেড়ে ওঠার গল্প বলছিলেন। ভাত ছিল প্রধান খাবার, আর ১৯৪২ সালের গ্রীষ্ম থেকে চালের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল।

ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
দুর্ভিক্ষের সময় এক শিশু রাস্তায় সাহায্য চাইছে
এরপর সে বছর অক্টোবরে ঘূর্ণিঝড় আসলো, যেটা তাদের বাড়ির ছাদ উড়িয়ে দিয়েছিল এবং সে বছরের ফসলও নষ্ট করে দেয়। খুব শীঘ্রই তাদের পরিবারের জন্য চাল কেনা সামর্থ্যের বাইরে চলে যায়।
“ক্ষুধা আমাদের তাড়া করতে থাকে। দুর্ভিক্ষ আর মহামারী। সব বয়সের মানুষ মারা যেতে থাকে।”
বিজয়কৃষ্ণ কিছু ত্রাণসামগ্রীর কথা মনে করতে পারেন, কিন্তু জানান সেগুলো ছিল খুবই অপ্রতুল।
“সবাই অর্ধেক খালি পেট নিয়ে বেঁচে ছিল,” তিনি বলেন, “যেহেতু খাবার জন্য কিছু ছিল না, গ্রামে অনেক মানুষ মারা যায়। অনেকে খাবারের খোঁজে লুটতরাজ শুরু করে।”
আমরা তার বাড়ির বারান্দায় বসে তার পরিবারের চার প্রজন্মের সাথে তার কথা শুনছিলাম। সেসময় সেখানে শৈলেন সরকারও ছিলেন, যিনি গত কয়েক বছর ধরে বাংলার গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে সেই ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ সামনে থেকে দেখা ও বেঁচে যাওয়াদের স্মৃতি সংগ্রহ করছেন।
৭২ বছর বয়সী এই লোকটি ভীষণ শান্ত স্বভাবের, চুল এখনও তরুণদের মতো এবং সহজেই হাসেন। আর এসব কারণেই বিজয়কৃষ্ণর মতো মানুষ খুব সহজেই তার কাছে মন খুলে কথা বলে।
তিনি একটা স্যান্ডেল পায়ে যেমন আবহাওয়াই থাকুক, কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে কিছু সিগারেট সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তিনি একটু পুরনো ধাঁচের, এখনো কাগজ-কলমেই সব লিখে রাখেন।

ছবির ক্যাপশান,
বিজয়কৃষ্ণ ত্রিপাঠি এবং শৈলেন সরকার
শৈলেন দুর্ভিক্ষের কয়েক বছর পরেই জন্মগ্রহণ এবং তার ভাষায় তিনি প্রথম এই বিষয়টির মধ্যে ঢুকে যান তার পরিবারের একটা ছবির অ্যালবামের কারণে। কলকাতার এক পিচ্চি ছেলে এই অ্যালবামটি উল্টে পাল্টে দেখতো এবং ছবির কৃশকায় সব লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতো।
ছবিগুলো তার বাবার তোলা, যিনি সেই সময় এক ভারতীয় দাতব্য সংস্থার সাথে যুক্ত থেকে দুর্ভিক্ষে ত্রাণ সহায়তা দিয়ে বেড়িয়েছিলেন। শৈলেন জানান তারা বাবা ছিল দরিদ্র ঘরের। তিনি বলেন, “আমার ছোটবেলাতেই আমি না খেয়ে থাকার কষ্টের সাথে পরিচিত হই।”
তবে তিনি তার এই নতুন লড়াই শুরু করেন ২০১৩ সালে শিক্ষকতার চাকরি থেকে অসবর নেবার পরে। মেদিনীপুরে হাঁটতে হাঁটতে তিনি এক ৮৬ বছরের বৃদ্ধের সাথে এই দুর্ভিক্ষের আলাপাচারিতায় জড়ান।
বিজয়কৃষ্ণের মতো শ্রীপতিচরণ সামন্তেরও সেই ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের কথা মনে আছে। সেই সময় জীবন ধারণ এমনিতেই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, এবং চালের দাম ধীরে ধীরে বাড়ছিল।
১৯৪২ সালে অক্টোবর নাগাদ তিনি দিনে একবেলা করে সামান্য ভাত খাচ্ছিলেন। এরপর আসে সেই ঘূর্ণিঝড়।
শ্রীপতিচরণ এখনো মনে করতে পারেন কিভাবে সেই ঘূর্ণিঝড়ের পর চালের দাম আকাশ ছুঁয়েছিল, এবং কীভাবে ব্যবসায়ীরা যে কোন দামে সেই অবশিষ্ট চাল কিনে নেন।
“খুব শিগগিরই আমাদের গ্রামে আর কোন চাল থাকলো না,” শৈলেনের কাছে বলছিলেন তিনি। “মানুষ কিছুদিন তাদের জমা করা খাবার খেল, আর এরপর তাদের জমি বেচতে শুরু করলো শুধুমাত্র কয়টা ভাতের জন্য।”
ঘূর্ণিঝড়ের পর তাদের পরিবারের জমা থাকা চালে মাত্র কয়েকদিন চলে, এরপর আরও লাখ লাখ মানুষের মতো তাদেরটাও শেষ হয়ে যায়।
শ্রীপতিচরণ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসেন – তিনি কলকাতায় চলে আসেন ত্রাণের আশায়। তিনি খুবই ভাগ্যবান ছিলেন যে তার পরিবারের একজন সেখানে ছিল যার সঙ্গে তিনি থাকেন এবং বেঁচে যান।
কিন্তু বেশিরভাগেরই সেই কপাল হয়নি, রাস্তায়, ডাস্টবিনের পাশে, ফুটপাতে তারা মরে পড়ে থাকেন অচেনা এক শহরে যেখানে তারা ভেবেছিল সাহায্য জুটবে।

ছবির উৎস, Sailen Sarkar
ছবির ক্যাপশান,
দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচার আশায় গ্রাম থেকে শহরে আসেন শ্রীপতিচরণ সামন্ত
দুর্ভিক্ষের কারণ ছিল অনেক এবং জটিল, আর সেসব নিয়ে এখনো বিতর্ক চলে।
১৯৪২ সালে বাংলায় চালের সরবরাহ সঙ্কটে পড়ে যায়। বাংলার সীমান্তে থাকা বার্মায় সে বছরের শুরুতে জাপানিরা হানা দেয় এবং হঠাৎ করেই সে দেশ থেকে চালের রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলা তখন যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনের খুব কাছাকাছি এবং কলকাতায় তখনো হাজারো মিত্রশক্তির সৈনিক এবং শ্রমিক উপস্থিত, যারা যুদ্ধকালীন বিভিন্ন শিল্পে যুক্ত, ফলে চালের চাহিদা তখন থেকেই বাড়ছিল। যুদ্ধের সময় মূল্যস্ফীতিও বাড়তে থাকে, ফলে আগে থেকেই বিপাকে থাকা মিলিয়ন মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায় চালের দাম।
অন্যদিকে ব্রিটিশরা ভয় পাচ্ছিল যে জাপানিরা পূর্ব ইন্ডিয়ার ভেতরেও ঢুকে পড়তে পারে এবং সেজন্য তারা সেসময় “বাতিল” নীতি গ্রহণ করে – যার মানে অতিরিক্ত চাল ও নৌকা যেগুলো বিভিন্ন গ্রাম বা শহর থেকে বাংলায় ঢুকছিল সেগুলো বাজেয়াপ্ত করে।
তাদের লক্ষ্য ছিল সামনে আসা যে কোন শক্তিকে খাবার ও পরিবহণ থেকে বঞ্চিত করা, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে আগে থেকেই ভঙ্গুর অর্থনীতি আরও ভেঙে পড়ে ও চালের দাম আরও বেড়ে যায়।
চাল গুদামজাত করা হত খাদ্য নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে, কিন্তু সেটা আসলে বেশিরভাগ সময় লাভের আশায় করা হত।

আর এসব কিছুর সাথে যোগ হয় ১৯৪২ সালের ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় যা অনেক ফসল নষ্ট করে এবং ফসলের রোগ ছড়ায়।
এই মানবিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কে এ নিয়ে দীর্ঘদিন করে উত্তপ্ত আলোচনা ও বিতর্ক আছে, বিশেষ করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল সেসময় একটা যুদ্ধের মাঝখানে এই দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা জানার পর ভারতীয়দের জন্য যথেষ্ট করেছিলন কি, সে প্রশ্ন আছে।
১৯৪৩ সালের শেষ দিকে নতুন ভাইসরয় ফিল্ড মার্শাল লর্ড ওয়াভেল আসার পর ত্রাণকাজ শুরু হয়, কিন্তু ততদিনে অনেকেই মারা যায়।
দুর্ভিক্ষের কারণ ও এর জন্য কে দায়ী এসব আলোচনায় অনেক সময় চাপা পড়ে যায় এতে যারা বেঁচে গিয়েছে তাদের কথা।
শৈলেন এখন পর্যন্ত ৬০ জনের বেশি প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা সংগ্রহ করেছেন। এদের বেশিরভাগেরই ব্যাপারেই তিনি বলেন, তারা অশিক্ষিত এবং দুর্ভিক্ষ নিয়ে তিনিও খুব একটা কথা বলেননি বা তাদের কেউ জিজ্ঞেসও করেনি, এমনকি তাদের পরিবারের লোকজনও না।
তাদের বর্ণনা সংগ্রহ করার জন্য কোন আর্কাইভেরও ব্যবস্থা নেই। শৈলেনের বিশ্বাস তাদের গল্পগুলো কখনো উঠে আসেনি কারণ তারা সমাজের সবচেয়ে গরীব এবং হুমকির মধ্যে থাকা মানুষ।
“এটা যেন তারা সবাই অপেক্ষায় ছিলেন, যদি কেউ এসে তাদের কথা শুনতে চায়,” বলেন তিনি।

ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
কলকাতায় স্যুপের জন্য দীর্ঘ লাইন
নিরাতন বেওয়ার সাথে যখন শৈলেনের দেখা হয় তখন তার বয়স ১০০ বছর। তিনি সেসময় য বাচ্চাদের দেখাশুনা করতে গিয়ে মায়েদের অসহনীয় যন্ত্রণার বর্ণনা দেন।
“মায়েদের কোন বুকের দুধ ছিল না। তাদের শরীরে তখন শুধু হাড্ডি, কোন মাংস নেই,” বলেন তিনি। “অনেকেই জন্মের সময় মারা যায়, তাদের মা-ও মারা যায়। এমনকি যারা স্বাস্থ্যবান জন্মেছিল তারা বড় হতে হতে ক্ষুধায় মারা যায়। অনেক নারী সেসময় আত্মহত্যা করেন।”
তিনি শৈলেনকে আরও বলেন, সেসময় অনেকের স্ত্রী স্বামী খাবার দিতে পারছিল না বলে অন্য লোকের হাত ধরে পালিয়ে যায়। “সেসময় মানুষের এসব নিয়ে এত ভয় ছিল না, আপনার পেটে যখন ভাত নেই এবং খাবার দেবার কেউ নেই, তখন আসলে এসব নিয়ে কে ভাবতে যায়,” বলেন তিনি।
শৈলেন সেসব মানুষের সাথেও কথা বলেছেন যারা দুর্ভিক্ষের সময় লাভবান হয়েছে। তার কাছে একজন স্বীকারও করেছে যে তিনি অনেক জমি কিনেছিলেন “সামান্য কিছু টাকা অথবা ভাত-ডালের বিনিময়ে।” তিনি শৈলেনকে আরও জানান, একজন কোন উত্তরাধিকার না রেখে মারা গেলে তিনি তার সম্পত্তিও নিজের করে নেন। একজন বেঙ্গলি-আমেরিকান লেখক কুশানাভা চৌধুরী একবার শৈলেনের সঙ্গী হয়ে এসব মানুষের সাথে দেখা করতে যান।
“আমাদের তাদের খুঁজতে হয়নি – তারা লুকিয়ে ছিল না, একেবারে চোখের সামনে, বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে, তারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর্কাইভ হয়ে বসেছিল,” বলেন তিনি।
“কারো তাদের সাথে কথা বলার দরকার মনে হয় নি। আমি নিজেই এটা ভেবে ভীষণ লজ্জিত।”

ছবির উৎস, Kushanava Choudhury
ছবির ক্যাপশান,
শৈলেন সরকার (বামে) ও কুশানাভা চৌধুরী (ডানে)
ভারতের কিছু বিখ্যাত চলচ্চিত্র, ছবি ও স্কেচে এই দুর্ভিক্ষকে মনে রাখা হয়েছে। কিন্তু কুশানাভা বলেন, সেখানকার ভিক্টিম যারা তাদের মুখে এই দুর্ভিক্ষ সেভাবে উঠে আসেনি: “এই গল্পগুলো লিখেছে তারা যাদের উপর এর কোন প্রভাব ছিল না। এটা খুবই মজার ঘটনা যে গল্পটা কারা বলছে আর বাস্তবতার মধ্যে কারা আছে।”
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্রুতি কাপিলা বলেন এই ভিক্টিমরা হয়তো আড়ালে পড়ে গেছেন কারণ ১৯৪০ এর সময়টাকে ভারতের জন্য বলা হয় “মৃত্যুর দশক”।
১৯৪৬ সালে কলকাতা জুড়ে প্রবল দাঙ্গায় হাজারো মানুষ মারা যায়। বছরখানেক পর ব্রিটিশরা দেশকে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত আর মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান এই দুই ভাগে ভাগ করে চলে যায়।
স্বাধীনতার আনন্দ ছিল, কিন্তু এই দেশভাগ ছিল রক্তাক্ত এবং সহিংস – প্রায় দশ লাখের বেশি মানুষ ধর্মীয় দাঙ্গায় প্রাণ হারায়। এক কোটি বিশ লাখের উপর মানুষ সীমান্ত পাড়ি দেয়।
বাংলাও ভাগ হয়ে ভারত এবং পূর্ব পাকিস্তান হয়, যেটা পরবর্তীতে বাংলাদেশ রুপ লাভ করে। সেই সময়ের বর্ণনা দেন অধ্যাপক কাপিলা, “সেই সময় টানা মৃত্যুর ঘটনাগুলোর মধ্য খুব সামান্যই বিরতি ছিল। আর সে কারণেই আমি মনে করি বাংলার দুর্ভিক্ষ সেভাবে উঠে আসে নি।”
তিনি যোগ করেন, এই ভারতীয় সাম্রাজ্যে টিকে থাকতে দুর্ভিক্ষ আর ক্ষুধার মুখোমুখি হয়েছে বহু ভারতীয়। এমনকি যারা নিজেরা দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়েনি বা ক্ষুধার মুখোমুখি হয় নি, তারাও যেটা দেখে সেটা কখনো ভোলে না।
দুর্ভিক্ষের সময় অমর্ত্য সেনের বয়স ছিল নয় এবং তাকে তার দাদার সাথে কলকাতা থেকে ১০০ মাইল উত্তরে শান্তিনিকেতনে পাঠানো হয় জাপানিজ বোমার ভয়ে।

ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
দুর্ভিক্ষের সময় অমর্ত্য সেনের বয়স ছিল নয়
তিনি মনে করতে পারেন ১৯৪৩ সালের এপ্রিলে একদিন স্কুলে একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। সবাই পড়া থামিয়ে দিয়ে দেখে একজন মানুষ হেঁটে স্কুলের মাঠে প্রবেশ করেছে।
“তিনি একেবারে হাড্ডিসার...কয়েক সপ্তাহ ধরে না খাওয়া, এবং তিনি খাবার খুঁজতে খুঁজতে আমাদের স্কুলে চলে এসেছেন। মানসিকভাবেও তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন না।”
অমর্ত্য তার নাম জানতে পারেননি তবে বুঝতে পেরেছিলেন যে মানুষটি মাসখানেক হল প্রায় না খেয়ে আছে। শিক্ষকরা দ্রুত সেখানে এসে লোকটিকে খেতে দেয়।
“আমি এর আগে কাউকে সেভাবে না খেয়ে থাকতে দেখিনি, আমার তখন শঙ্কা হতে থাকে যে লোকটি হয়তো সেখানে হঠাৎ মারা যাবে।”
তবে এটা শুধুমাত্র একটা ঘটনা ছিল না। দাদাবাড়ির কাছে রাস্তায় অমর্ত্য দেখতে পান ক্ষুধার্ত মানুষ সব কলকাতার দিকে চলেছে। আর সেই দৃশ্য তাকে রাতে তাড়া করে ফিরতো।
“তাদের ভুলে যাওয়া খুব কঠিন ছিল,” স্মৃতি মনে করেন তিনি। “সেই ঘটনা এতটাই জঘন্য, হীন এবং মানসিকভাবে অস্বস্তির ছিল যে তাদের কী হবে সেটা ভুলে রাতে ঘুমানোটা ছিল অসম্ভব।”
অমর্ত্য এই কষ্ট লাঘবে কিছু করতে চেয়েছিলেন। তিনি তার দাদিকে জিজ্ঞেস করেন তারা একটু চাল দিতে পারে কি না? তখন তিনি তার সিগারেটের টিন বের করে বলেন, সে এটার অর্ধেক ভরে দিতে পারে।
অমর্ত্য সেটাই করেছিলেন। “মাঝেমধ্যে আমি অর্ধেক টিন ভরার নিয়মটা ভেঙে তার চেয়ে বেশি দিতাম।”

ছবির উৎস, Sailen Sarkar
ছবির ক্যাপশান,
অনঙ্গমোহন দাস
২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন ভারতীয় সরকার জরুরী অবস্থা চালু করে সেসময় “দুর্ভিক্ষ” শব্দ বলাটা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষের শঙ্কা ছিল যে এটা জাপানিজ ও জার্মানরা প্রপাগান্ডা হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
কিন্তু ভারতের ফটোগ্রাফার, লেখক ও আর্টিস্টরা এর মধ্যেই যতোটা পারেন সেই দুর্ভিক্ষের চিত্র তুলে ধরেন। চিত্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য একটা লিফলেট তৈরি করেন, “হাংরি বেঙ্গল: অ্যা ট্যুর থ্রু মেদিনীপুর ডিস্ট্রিক্ট” এই নামে।
এর মধ্যে দুর্ভিক্ষে মারা পড়া ও বেঁচে যাওয়াদের স্কেচও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি সেই সব মানুষদের নাম দেন, তারা কে, কোথা থেকে এসেছে সেসব বর্ণনাও। যখন ১৯৪৩ সালে এটা প্রকাশ হয় তখন এর প্রায় ৫ হাজার কপিই বাজেয়াপ্ত করে ব্রিটিশরা।
ব্রিটিশ মালিকানার স্টেটসম্যান নিউজপেপারের সম্পাদক ইয়ান স্টিফেন্সও ১৯৪৩ সালের গ্রীষ্মের সময়কালের চিত্র তুলে আনতে গিয়ে নানা জটিলতায় পড়েন।
১৯৭০ সালে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “সে সময়ের মানবিক পরিস্থিতি আমাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। মানুষের এই কষ্ট এবং সেটা লাঘবে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা দেখে আমার ভীষণ ক্ষোভ হয়।”
তিনি কড়া নিয়মের ফাঁক দিয়ে ১৯৪৩ সালের ২২শে অগাস্ট এক ভিক্টিমের ছবি প্রকাশ করেন যিনি কলকাতার রাস্তায় মারা যাচ্ছিলেন বা মারা গিয়েছিলেন।
সেটা প্রথমে দিল্লিতে যায় এরপর সারা বিশ্বের তা নজর কাড়ে। তিনি এরপর আরও ছবি এবং কড়া সম্পাদকীয় লেখেন। শীঘ্রই গোটা বিশ্ব জেনে যায় সেখানে কী হচ্ছে।
অমর্ত্য সেন, যিনি পরে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন, তিনি এই দুর্ভিক্ষের কারণ ও প্রভাব নিয়ে পড়াশোনা করেন, পরবর্তী জীবনে স্টিফেনের সাথে তার দেখা হয় এবং বলেন “তিনি অনেকের জীবন বাঁচিয়েছেন” তার পত্রিকার মাধ্যমে।
৮০ বছর পর এই দুর্ভিক্ষের অল্প কয়েকজন স্বাক্ষী এখনো বেঁচে আছেন। শৈলেন একবার যখন ৯১ বছর বয়সী অনঙ্গমোহন দাসের সঙ্গে দেখা করতে যান, তিনি সেখানে কেন এসেছেন সেটা শোনার পর মানুষটি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। এরপর তার চোখ বেয়ে দরদর করে পানি পড়তে থাকে ও তিনি বলেন, “এতদিন লাগলো আসতে?”
কিন্তু যে কয়েকজনের বর্ণনা শৈলেন সংগ্রহ করেছেন সেটা আসলে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ মারা যাওয়া ও তাদের জীবন বদলের যাওয়ার যে ঘটনা তার তুলনায় খুবই সামান্য।
“আপনি যখন ইতিহাস ভুলে যেতে চান,” বলেন তিনি, “তখন আসলে আপনি সবকিছুই ভুলে যেতে চান।” কিন্তু শৈলেন সেটা না হতে দিতে বদ্ধপরিকর।