পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রে সাধারণ নির্বাচন শেষ হল। সাত পর্যায়ে ৬ সপ্তাহ ধরে চলেছে নির্বাচন। ভোটদাতাদের সংখ্যাও ছিল সর্ববৃহৎ, কয়েকশ’ মিলিয়ন। এখন পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন রাজ্যের ফলাফল ঘোষণা করা হচ্ছে।

নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়নি। পশ্চিমবঙ্গসহ কয়েকটি রাজ্যে হানাহানি হয়েছে। কোথাও খুনোখুনিও হয়েছে। এই লোকসভা নির্বাচন নির্ধারণ করবে ভারতের ভবিষ্যৎ। গণতান্ত্রিক ভারত না হিন্দুত্ববাদী ভারত? ২০১৪ সালের ক্যারিশম্যাটিক মোদি কি আবারও দিল্লিতে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবেন? সবার মনেই এই প্রশ্ন। সবার দৃষ্টি নির্বাচনের ফলাফলের দিকে।

এই ফলাফল সম্পর্কে আগেও প্রেডিকশন করা যায়নি, এখনও করা যাচ্ছে না। সম্ভবত প্রেডিকশনের ওপর নির্ভর না করে আর কিছুদিনের মধ্যে যে চূড়ান্ত ফল জানা যাবে তার জন্য অপেক্ষা করাই ভালো। তবু বিশ্বের এত বড় নির্বাচনের ফল সম্পর্কে একটু আগাম আলোচনা করছি। যদি সঠিক না হয়, সেজন্য পাঠকদের কাছে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। নরেন্দ্র মোদির বিজেপি দলের এক বিশিষ্ট নেতা রাখঢাক না করে নির্বাচনের ফল সম্পর্কে বলেছেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো মোদি-ম্যাজিক এবার কাজ করবে না। বিজেপি এবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। সরকার গঠনে তাকে সঙ্গী জোটাতে হবে।’

আমার মনে হয়, এই প্রেডিকশনটি বাস্তবতার খুব কাছাকাছি। বিজেপি সব দলের চেয়ে বেশি আসন পেলেও অন্য দলের সমর্থন না পেলে কেন্দ্রে স্থিতিশীল সরকার গঠন করতে পারবে না। বাজপেয়ি সরকারের মতো টানাপোড়েন লেগেই থাকবে। এর বড় কারণ, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের দরিদ্র মানুষকে মোদি যে আকাশচুম্বী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা পূরণ করতে পারেননি, তার ওপর যে নির্বাচনী স্লোগান ২০১৪ সালে দিয়েছিলেন, ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ তা এবার তার কানেই পরিহাসের মতো শোনাচ্ছে।

মোদি তার উগ্র হিন্দুত্ববাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে পারেননি। বরং ভারতের জাতীয় ঐক্যে গুরুতর ভাঙন ধরেছে। আমেরিকার ম্যাগাজিন ‘টাইম’ তার ২০ মে’র সংখ্যা মোদিকে প্রচ্ছদ ছবি করে তাকে আখ্যা দিয়েছে ‘ইনডিয়াস ডিভাইডার ইন চিফ বা ভারতের ঐক্যের প্রধান বিভাজনকারী।’ তার আমলে কৃষক ফসলের দাম পায়নি। দলে দলে কৃষক আত্মহত্যা করেছে। আকস্মিকভাবে উচ্চমূল্যের ব্যাংক নোট বাতিল, সারা ভারতে সাধারণ মানুষের জীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। নারী নির্যাতন বেড়েছে বহুগুণ। সংখ্যালঘু নির্যাতন বলতে মোদি যুগে শুধু মুসলমান বা খ্রিস্টান নির্যাতন বোঝায় না, দলিত বা নিুবর্ণের হিন্দুদের ওপর নির্যাতন চলছে ভয়াবহভাবে।

নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তিনি গরিবের ওপর ট্যাক্সের বোঝা বাড়িয়ে ঋণখেলাপি ও দেশ থেকে পলাতক অসাধু ধনী ব্যবসায়ীদের পেট্রন হয়ে দাঁড়িয়েছেন। রাফায়েল যুদ্ধবিমান ক্রয়সংক্রান্ত বিরাট দুর্নীতির অভিযোগ তুলে কংগ্রস নেতা রাহুল গান্ধী দেশময় এমন শোরগোল তুলেছেন যে, এ সময় মনে হয়েছিল যে দ্বিতীয়বার দিল্লির তখ্তে বসা নরেন্দ্র মোদির জন্য অসম্ভব হয়ে যাবে। এই অবস্থা থেকে অত্যাশ্চর্যভাবে বেঁচে গেছেন তিনি।

চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় কাশ্মীরে ভারতের প্যারা মিলিশিয়ার ওপর ভয়াবহ টেরোরিস্ট হামলা হয়। হতাহতের সংখ্যা ছিল বিরাট। সঙ্গে সঙ্গে এই হামলার দায়িত্ব পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে দিয়ে মোদি সরকার পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালান। উপমহাদেশে যুদ্ধ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের মানুষের দৃষ্টি মোদি সরকারের ব্যর্থতার দিক থেকে সরে গিয়ে পাকিস্তানকে শিক্ষা দেয়ার সাহস ও দক্ষতার দিকে সরে আসে। বিজেপির পার্টি মেশিনারি পাকিস্তানে এই বিমান হামলার ঘটনাকে ফাঁপিয়ে-ফুলিয়ে প্রধানমন্ত্রীর লৌহকঠিন চরিত্র ও সাফল্য হিসেবে প্রচার করে এবং তার রাজনৈতিক ফায়দা লোটে।

হিন্দুত্ববাদ এবং পাকিস্তানে বোমাবর্ষণের কথিত সাফল্য নির্বাচনে বিজেপির বড় মূলধন হয়ে দাঁড়ায়। রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস এবং মমতা ব্যানার্জির তৃণমূলসহ বিজেপিবিরোধী দলগুলোর ব্যর্থতা এই যে, তারা হিন্দোইজম ও পাকিস্তানে জঙ্গিপনা নিয়ে দেশে বিজেপির নতুন উন্মাদনা সৃষ্টি প্রতিরোধ করতে পারেনি। বরং কংগ্রেস মোদি-অমিত শাহের হিন্দুত্ববাদী প্রচারণার ফাঁদে পা দিয়েছে। অতীতে সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ডাক দিয়ে কংগ্রেস নির্বাচনে জয়ী হতে পেরেছিল। এবার কে বা কারা রাহুল গান্ধীকে পরামর্শ দিয়েছেন, কংগ্রেসকেও হিন্দুত্ববাদী সাজালে নির্বাচনে বিজেপিকে হঠানো সম্ভব হবে।

রাহুল গান্ধী হঠাৎ নিজেকে শিবভক্ত ঘোষণা করেন এবং মন্দিরে মন্দিরে গিয়ে নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে পুজো দিতে শুরু করেন। মোদির ক্যারিশমা ও রাজনৈতিক কৌশলের সঙ্গে টেক্কা দেয়ার মতো পরিপক্ব রাহুল এখনও হয়ে ওঠেননি। এই ঘাটতি পূরণের জন্য তার বোন অধিক জনপ্রিয় প্রিয়াংকাকে রাজনীতিতে আনা হয়েছে। সোনিয়া, রাহুল, প্রিয়াংকা ঘটা করে পূজা-পার্বণ করে তাদের হাতে যে হিন্দুধর্ম ও হিন্দুস্বার্থ আরও নিরাপদ এটা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। কংগ্রেসের এই নীতিবিরুদ্ধ রণকৌশল সফল হয়েছে কিনা, তা নির্বাচনের ফলাফল বেরোলেই বোঝা যাবে। যদি কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিজেপিবিরোধীরা নির্বাচনে জয়ী হয় তাহলে বুঝতে হবে কংগ্রেস বিষে বিষক্ষয় করতে পেরেছে। আর হারলে বলতে হবে কংগ্রেস নিজের নাক কেটে নরুন পেয়েছে।

নরেন্দ্র মোদি আগের জনপ্রিয়তা হারালেও কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলো তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী ঐক্য গড়ে তুলতে পারেনি। গান্ধী-নেহেরুর গণতান্ত্রিক ভারতের মূল শক্তি ধর্মনিরপেক্ষতাকে নির্বাচনী যুদ্ধে সামনে নিয়ে আসতে পারেনি। মোদির বিরোধিতায় সবচেয়ে মুখর মমতা ব্যানার্জিও তার বিরোধিতাকে নীতিভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে পারেনি। তিনি মোদির বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ চালিয়েছেন। নিজেকে ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী পদে মোদির বিকল্প হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। যদিও গত কয়েক বছরে হিন্দি-বলয়ে প্রভাব হারিয়ে বিজেপি প্রভাব বাড়িয়েছে পশ্চিমবঙ্গেই। ত্রিপুরায় ক্ষমতা দখল করেছে।

নরেন্দ্র মোদি যদিও ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করতে পারেননি; কিন্তু অর্থনৈতিক ও বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে সাফল্য দেখতে পারেননি, তা নয়। হাইওয়ে, নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ, নতুন এয়ারপোর্ট তৈরি, একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত বিদ্যুৎ সম্প্রসারণ দ্বারা তিনি অর্থনীতিরও সমৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে দীর্ঘকালীন প্রত্যক্ষ বিরোধের অবসান, একইসঙ্গে আমেরিকা ও রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী তার সাফল্যের প্রমাণ।

প্রতিবেশী দেশগুলোর (একমাত্র পাকিস্তান ছাড়া) বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে তার মৈত্রী উপমহাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দান করেছে। তার ফলে এবারের নির্বাচনে মোদি হাওয়া না থাকলেও বিজেপি দিল্লির তখ্ত হারাবে মনে হয় না। মোদির প্রতি মোহ মানুষ হারাতে পারে; কিন্তু হিন্দুত্ববাদের মোহ ভারতেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের এক বিশাল অংশের মধ্যে এখনও বিরাজ করছে। বিজেপির এটাই সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক মূলধন।

তারপরও যদি এই নির্বাচনে বিজেপি হারে, তাহলে বুঝতে হবে, দেশ পরিচালনায় হিন্দুত্ববাদের বাড়াবাড়ি, সংখ্যালঘু নির্যাতন, দুর্নীতির অভিযোগ, প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থতা নির্বাচকমণ্ডলীর এক বড় অংশকে বিজেপির প্রতি বিমুখ করেছে। কংগ্রেস ও বিরোধী দলগুলো নিজেদের ঐক্য ও জনপ্রিয়তার জোরে নির্বাচনে জেতেনি। রাষ্ট্রপরিচালনায় বিজেপির সাধারণ মানুষের যে আশাভঙ্গ করেছে, সেটাই তার পরাজয়ের মূল কারণ।

আমার ধারণা, বর্তমান নির্বাচনে কংগ্রেসি জোট অথবা বিজেপি যারাই জয়ী হোন, তারা একক সরকার গঠন করতে পারবেন না। সরকার গঠনে তাদের সঙ্গী খুঁজতে হবে। এক্ষেত্রে বিজেপিরই সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তা যদি হয় তার ভালো দিক হবে প্রধানমন্ত্রী মোদির ওপর কট্টর হিন্দুত্ববাদী শিবসেনা, আরএসএস ইত্যাদি দলের যে একচ্ছত্র প্রভাব, তা থেকে তিনি মুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবেন। এমনও হতে পারে, তিনি অটল বিহারি বাজপেয়ির মতো মডারেট হওয়ার চেষ্টা করবেন। আমার এই অনুমান সঠিক কিনা, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পাঠকরা জানতে পারবেন। সুতরাং একটু অপেক্ষা করুন।

লন্ডন ১৯ মে, রবিবার, ২০১৯



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews