মানুষ কীভাবে আজকের এই অবস্থানে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে? কীভাবে পৃথিবীর প্রায় সবকিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে?—এই প্রশ্নগুলোর জবাব বিভিন্ন দিক থেকে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু এই প্রশ্নগুলোর যে জবাব ইউভাল নোয়া হারারি দিয়েছেন, আমার কাছে ভালো লাগে সেটা। তিনি তার অত্যন্ত আলোচিত বই ‘সেপিয়েন্স: অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অব হিউম্যানকাইন্ড’-এ বেশকিছু বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন মানুষের বয়ান (স্টোরি) তৈরির ক্ষমতাকে।
হারারি বলেন, বিবর্তনের একটা পর্যায়ে এসে মানুষ বয়ান তৈরি করার ক্ষমতা অর্জন করে। কোনও একজন মানুষ যদি একটা গ্রহণযোগ্য বয়ান তৈরি করতে পারে এবং সে যদি সক্ষম হয় তাহলে আরও অনেক মানুষকে সেই বয়ানের সমর্থনে নিয়ে আসতে পারে। বয়ান বিশ্বাস করিয়ে মানুষকে সংগঠিত করে অসাধারণ সব কাজ করানো যায়। আবার পৃথিবীর যাবতীয় ধ্বংসাত্মক কাজও হয়েছে বয়ান সামনে রেখে। হারারি বলেন, সব রাজনৈতিক ব্যবস্থা (যেমন, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র), বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, এমনকি রাষ্ট্র নিজেই একটা গল্প। তার বিবেচনায় মানুষের তৈরি করা সবচেয়ে স্মার্ট গল্পটি হচ্ছে টাকা।
মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলে আমরা দেখবো, সরকার দীর্ঘদিন থেকে একটা বয়ান তৈরি করার চেষ্টা করছে। সেটি হলো–‘উন্নয়নের বয়ান’। সেতু-ফ্লাইওভার-মহাসড়ক—এই ধরনের কিছু নির্মাণ, জিডিপির গ্রোথ, মাথাপিছু আয় দেখিয়ে সরকার একটা ‘উন্নয়নের বয়ান’ ‘খাড়া’ করেছে। এই উন্নয়নের বয়ানকেই এই সরকার তাদের ব্যর্থতা ঢেকে রাখার লাইসেন্স হিসেবে দেখাতে চাইছে। সেই চেষ্টায় তারা কতটা সফল হয়েছে, তা ভিন্ন আলোচনা।

চোরাই পথে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টায় ভূমধ্যসাগরের বাংলাদেশের তরুণদের মৃত্যু নিত্যকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবশেষের ঘটনাটি ঘটলো কয়েক দিন আগে। যৌক্তিকভাবেই এর পেছনে দেশের সত্যিকারের সমস্যা উঠে এসেছে অনেকের লেখায়। কিন্তু কেউ কেউ তাদের লেখায় দেখানোর চেষ্টা করেছেন, এরা মূলত লোভের কারণে ওইসব দেশে পাড়ি জমায়।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে রাজধানীর একটি হোটেলে কানাডার হাইকমিশনের আয়োজনে এক অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের সূত্র ধরে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে একটা বড় ধরনের সমস্যা হয়ে যাচ্ছে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি।’

বাংলাদেশে জবলেস গ্রোথ হচ্ছে, এটা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়ারও দরকার নেই, যদিও এটা অর্থনীতিবিদরা অনেক আগে থেকেই বলে যাচ্ছিলেন।

এই দেশের রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো আমাদের জানায়, এই দেশে প্রকৃত কর্মহীনের সংখ্যা ৪ কোটি ৮২ লাখ। যদিও আইএলও’র বেকারত্বের সংজ্ঞা (অর্থনীতিবিদদের মতে এই সংজ্ঞা কোনোভাবেই বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য না) ব্যবহার করে এটাকে খুব ক্ষুদ্র একটা সংখ্যা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা সরকারের দিক থেকে আছে। অন্যদিকে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। দক্ষিণ এশিয়ায় এর চেয়ে বেশি উচ্চশিক্ষিত বেকার আছে কেবল আফগানিস্তানে। ইউরোপ যাওয়া-আসায় জীবনের ঝুঁকি মানুষ এমনি এমনি নেয় না।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. রঘুরাম রাজন সম্প্রতি বিখ্যাত হয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর হয়ে। আমরা অনেকেই জানি না, ড. রাজন বিশ্ববিখ্যাত হয়ে ওঠেন ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার সময়। এই মন্দা আসছে এই ভবিষ্যদ্বাণী হাতেগোনা যে কয়েকজন মানুষ করেছেন, রাজন তাদের একজন। 

ভারতেও বেকারত্ব একটা খুব বড় ইস্যু, কারণ সেখানেও জবলেস গ্রোথ হচ্ছে। এ ব্যাপারে যখন রাজনের মন্তব্য চাওয়া হয়, তখন তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, জবলেস গ্রোথ আদতে কোনও গ্রোথই না। জানি, এই সহজ কথাটা বলার জন্য রাজনকে ডেকে আনার কোনও দরকার হয়তো ছিল না। অতি সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই এটা বোঝা যায়। তবু এটা কেন করেছি, সেটা আশা করি পাঠক বুঝবেন।

ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচের কাছাকাছি মূল্য না পাওয়া কৃষকের আহাজারি এখন আরেক আলোচিত বিষয়। আমরা, মধ্যবিত্তরা এসব নিয়ে খুব একটা মাথা না ঘামালেও জনৈক কৃষকের ধানের ক্ষেতে আগুন দেওয়ার পর আমাদের অনেকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন ধানে আগুন দেওয়া নাকি পরিকল্পিত, যদিও তার এই মন্তব্যের দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছেন তার দলেরই নেতা, জাতীয় সংসদের হুইপ ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ। তাই ওই প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। 

দুটি বিরাট জনগোষ্ঠী চালের দাম নিয়ে ভুক্তভোগী হয়। একদিকে অসংখ্য কৃষক ন্যায্যমূল্য না পেয়ে হাহাকার করে, অন্যদিকে কোটি কোটি ভোক্তা চালের উচ্চমূল্যের কারণে সমস্যায় পড়ে। এর পেছনে মূল দায় যাদের, যেমন চাতাল মালিক, আড়তদার ও রাইস মিলের মালিক। সরকার কাজ করে মূলত তাদের স্বার্থেই। সরকার কেন অতি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থের পক্ষে কাজ করে না, সেই প্রসঙ্গে একটু পরেই আসছি। মজার ব্যাপার, এর একটি স্পষ্ট স্বীকৃতি দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী। ১৬ মে তিনি বলেন, ‘কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনায় বাধা রাজনৈতিক প্রভাব’। 

২০০৯-এর পর থেকেই, বিশেষ করে ২০১৪ সালের সরকারের সময় থেকে বাংলাদেশ ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’-এর এক চমৎকার উদাহরণ হয়ে আছে। কিছু স্বার্থান্বেষী লোক দেশের যাবতীয় সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে এবং সব সম্পদ লুটপাট করে। তাই দেশের তথাকথিত উন্নয়নের মূল সুফলভোগী তারাই হয়। এরকম কিছু মানুষের প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য দেশের সার্বিক উন্নতি এবং প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। 

মেক্সিকোর ধনকুবের কার্লোস স্লিমের মনোপলি টেলিকম ব্যবসা নিশ্চিত করার জন্য মেক্সিকোর জিডিপি ২০০৫ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত অন্তত ২ শতাংশ কম হয়েছিল। টাকার অঙ্কে এটা কমপক্ষে ১৩ হাজার কোটি ডলার। স্মরণ করতে পারি ১৯৯১ সালের বিএনপি সরকারের সময়ও একজন টেলিকম ব্যবসায়ীর জন্য একই ধরনের মনোপলি টেলিকম ব্যবসা নিশ্চিত করা হয়েছিল। এই চর্চা বর্তমান সরকারটির সময়ে বহুগুণে বেশি হয়েছে। হাতেগোনা কিছু লুটপাটকারীর একচেটিয়া সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশেও প্রবৃদ্ধির একইরকম সমস্যা হয়। বাংলাদেশের জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি নিয়ে এক ধরনের অতিরঞ্জন আছে, এটা অর্থনীতিবিদরা খুব স্পষ্টভাবেই প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। তর্কের খাতিরে যদি সেটাকে ভুল মনে করে সরকারি হিসাবকেও সঠিক ধরি, তাহলেও এটা বলতেই পারি, আজ এই লুটপাটের অর্থনীতির কারণেই বাংলাদেশের জিডিপি কমপক্ষে ১০ শতাংশ হয়নি। লুটপাট কম হলে এটা আরও আগেই ১০ শতাংশ বা তারও বেশি হতো। 

আমাদের কাছে শুনতে খারাপ লাগলেও এটা বলতেই হয়, নিখাদ অর্থনীতির দিক থেকে দেখলে লুটপাট করা টাকারও একটা অর্থনৈতিক প্রভাব আছে। লুটপাটের টাকা যদি দেশে বিনিয়োগ করা হতো, সেই টাকাও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ হয়ে মানুষের কাজে লাগতো। লুটপাটের টাকা দিয়ে শিল্প কারখানা, ব্যবসা তৈরি হলে সেটা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারতো। এমনকি লুটপাটের টাকা স্রেফ ভোগে ব্যয় করা হলেও সেটা পরোক্ষভাবে শিল্প এবং ব্যবসার প্রবৃদ্ধি ঘটিয়ে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে পারতো। কিন্তু দেশের এই টাকাগুলো আবার পাচার হয় বিদেশে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির হিসাবে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়।

মজার ব্যাপার, কীভাবে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়, কীভাবে সরকারি ব্যয়ের কারণে জিডিপি বাড়ে, কিন্তু সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের কারণে সেটা দেশে কর্মসংস্থান তৈরি করে না, কীভাবে কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার মালিক অতি ধনী (বৃদ্ধির হার পৃথিবীতে সর্বোচ্চ) আর কমপক্ষে ৮ কোটি টাকার মালিক ধনীদের (বৃদ্ধির হার পৃথিবীতে তৃতীয় সর্বোচ্চ) আয়ের গড় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে মূল প্রভাব রাখে সেসব প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে আছে। ওদিকে এই দেশে বৈষম্যের সীমাহীন বৃদ্ধি পাওয়ার, সমাজের ধনীদের আরও অনেক বেশি ধনী হওয়ার, আর গরিব আরও গরিব হয়ে যাওয়ার যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ডাটা থেকেই পাওয়া যায়।

দুটো ঘটনা, ভূমধ্যসাগরে মৃত্যু আর ধানের দাম বোতলজাত পানির দামের চেয়ে কমে যাওয়ায় কৃষকের আহাজারির কথা এই লেখায় আনা হয়েছে এগুলো খুব সাম্প্রতিক ঘটনা বলে। এমন অসংখ্য ঘটনা দেশের আনাচে-কানাচে প্রতিনিয়ত ঘটে যেগুলোর সঙ্গে তথ্য-উপাত্ত যুক্ত করে খুব শক্ত পাল্টা বয়ান তৈরি করা যায়, এই রাষ্ট্রে উন্নয়নের নাম করে সারা দেশের মানুষের সম্পদ কার্যত হাতেগোনা কিছু মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত করা হয়েছে। এই মুহূর্তে সরকারি দলের জোটে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরের আর সব দলের খুব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হবে সরকারি বয়ানের বিরুদ্ধে এই বয়ান নিয়ে মানুষের সামনে যাওয়া এবং মানুষকে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তোলা। 

লেখক: সদস্য, স্টিয়ারিং কমিটি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, নাগরিক ঐক্য



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews